কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থা নিরব, কদাকার আবর্তনের দিকে যাচ্ছে

জুলাই ২৭, ২০১৪: বিদেশী শ্রমিকদের সাময়িক কর্মসূচি নিয়ে সম্প্রতি যে কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে তাতে কানাডীয়দের হতাশ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু আসুন আমরা যেন নিজেরা বোকা না বনি: আসলে এই কর্মসূচি এবং এর অব্যবস্থাপনার পুরো বিষয়টি হলো একটি ব্যবস্থার ব্যাপকভিত্তিক ও নিরব সংস্কারের অংশমাত্র যে ব্যবস্থার আদৌ কোন সংস্কারের প্রয়োজন হয়তো ছিলো না।

টরন্টোর রায়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মর্যাদাপূর্ণ সংগঠন মাইগ্রেশন পলিসি গ্র“পের অংশীদারিত্বে কানাডার জন্য অভিবাসন নীতির কার্যকারিতার সূচক বা গরমৎধঃরড়হ চড়ষরপু ঊভভবপঃরাবহবংং ওহফবী (গওচঊঢ) তৈরি করছেন। মাইপেক্স-এ অভিবাসন নীতির ভিত্তিতে দেশগুলোর মধ্যে তুলনা করা হয় এবং তাদের রেটিং দেয়া হয়। এই রেটিংয়ে ২০১১ সালে কানাডা তিনটি সেরা দেশের মধ্যে ছিলো কিন্তু তার পর থেকে যেসব ঘটনা ঘটছে তার ফলাফল দেখে রায়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলটি রীতিমত আহত হয়েছে।

কানাডার এককালে নতুন পথ সৃষ্টিকারী অভিবাসন নীতিকে পরে এমন এক ব্যবস্থায় রূপান্তর করা হয়েছে যা প্রধানত চাকরিদাতাদের সুবিধা দেয়, অভিবাসীদেরকে আর দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসাবে কিংবা কানাডীয় সমাজ বা পরিবারের ভবিষ্যৎ সদস্য হিসাবে দেখা হয় না বরং তাদেরকে দেখা হয় সুবিধাজনক ও শস্তা শ্রমিক হিসাবে। এটি আগের নীতি থেকে স্পষ্টভাবেই সরে আসা।

১৯৬৭ সালের অভিবাসন আইন প্রণয়নের পর থেকে কানাডা বিদেশীদের শিক্ষা, কাজের অভিজ্ঞতা এবং ইংরেজি বা ফরাসী ভাষায় তাদের দক্ষতার বিচারে অভিবাসী বাছাই করে আসছিলো। এক্ষেত্রে পয়েন্ট নির্ধারণের পদ্ধতি অভিবাসী বাছাইকে স্বচ্ছতা দিয়েছে এবং এর ফলে বর্ণবাদী নীতির প্রাধান্য থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। পয়েন্ট পদ্ধতির বাস্তববাদিতা ও সমতার নীতি অন্যান্য দেশেরও শ্রদ্ধা অর্জন করেছে এবং বেশ কয়েকটি দেশ এই পদ্ধতিকে তাদের নিজস্ব অভিবাসন নীতিতে বাস্তবায়নের কথা ভাবছে।

বর্তমান সরকার যদি তার নিজস্ব পথেই চলতে থাকে তাহলে কানাডা থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে পয়েন্ট পদ্ধতির অবসান ঘটবে এবং তার পরিবর্তে এক্সপ্রেস এন্ট্রি ব্যবস্থা চালু হবে যা হবে বস্তুত একটি ‘চাকরির ব্যাংক’ যা সরকার ও শিল্প খাতের জন্য সহায়ক হবে এবং এই ব্যবস্থা সম্ভাব্য অভিবাসীদেরকে কর্মচারী চায় এমন চাকরিদাতাদের সঙ্গে মিলিয়ে দেবে। কানাডার নাগরিকত্ব ও অভিবাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নতুন কর্মসূচির কাজ হবে, ‘‘আবেদনকারীদের মধ্য থেকে সবচেয়ে ভাল মানুষটিকে নয় বরং সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থীকে বাছাই করে নেয়া।’’ ভাগ্যের পরিহাস হলো এই যে, এই একই সরকার উদ্বাস্তুদেরকে ‘‘কিউ থেকে লাফিয়ে পড়া’’ হিসাবে অভিযুক্ত করে এবং কানাডার সুরক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় লোকদেরকে আবাসিকের মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।

১৯২৫ সালের রেলওয়ে আইনের পর থেকে এমন নগ্ন বাস্তববাদিতা আর কখনই দেখা যায়নি। ১৯২৫ সালের রেলওয়ে আইনে কানাডার দু’টি রেল কোম্পানিকে কার্যত অভিবাসনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দান করে। প্রায় শতাব্দীকাল আগে বাস্তববাদিতার ওপর বিজয় কানাডাকে বাইরের লোকদের এদেশে ঢুকতে দেয়া এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের শ্রম কানাডার জন্য প্রয়োজন ঠিক ততক্ষণই এখানে থাকার সুযোগ দেয়। তারা যদি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে এখানে থাকতো তাহলে চাইনিজ হেড ট্যাক্সের মত কুখ্যাত ব্যবস্থা তাদেরকে তাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে মিলিত হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতো। (অর্থাৎ তারা চিরকালের জন্য শ্বেতাঙ্গ কানাডীয়দের ক্রীতদাসে পরিণত হতো)

১৯৬৭ সালের অভিবাসন আইনে পরিবারের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়া হয় এবং এতে অভিবাসীরা তাদের স্বামী বা স্ত্রী, নির্ভরশীল ছেলেমেয়ে, বাবা-মা এবং দাদা-দাদীকে স্পন্সর করতে পারে এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। এই নীতির মূল চেতনা এখন হুমকির মুখে। এখন কানাডা ২২ বছর বয়সী সন্তানকে নির্ভরশীল বলে মেনে নেয় না তবে সরকার এই বয়সসীমা ১৯ বছরে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে।

২০১২ সালে সরকার বাবা-মা এবং দাদা-দাদীকে স্পন্সর করার ওপর দুই বছরের বিধিনিষেধ আরোপ করে। অবশ্য চলতি বছরের শুরুর দিকে এই বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হয়েছে। তবে একটি নাটকীয়ভাবে ভিন্ন ধরণের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে যার ফলে আত্মীয়দের স্পন্সর করতে চান এমন অভিবাসী পরিবারের ন্যূনতম আয় অন্তত ৩০ শতাংশ বেশি থাকতে হবে বলে শর্ত আরোপ করা হয়েছে। আগে যেখানে অভিবাসী পরিবারের স্পন্সর করা সদস্যদের ১০ বছর পর্যন্ত সমর্থন দেয়ার বিধান ছিলো এখন সেটি ২০ বছর করা হয়েছে। এছাড়াও স্পন্সর করার অনুমতি দেয়ার সংখ্যা বছরে ৫ হাজারে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে।

রক্ষণশীল সরকার কেবল কানাডায় প্রবেশের বিষয়টিকে কঠিন করে তোলেনি বরং এখানে থাকা এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগও কঠিন করে তুলেছে। বর্তমানে পার্লামেন্টে বিবেচনাধীন নাগরিকত্ব আইন সি-২৪-এ নাগরিক হওয়ার জন্য কানাডায় বসবাসের সময়সীমা ৩ বছর থেকে বাড়িয়ে ৪ বছর করা হয়েছে, আবেদনের ফি তিন গুণ বাড়িয়েছে, নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত দেয়া হলে তার বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ রহিত করেছে, একজন কর্মকর্তা যদি মনে করেন যে কোন ব্যক্তি আসলে কখনই কানাডায় বসবাস করতে চান না তাহলে স্বাভাবিকভাবে নাগরিকত্ব পাবার যোগ্য কোন ব্যক্তির (হধঃঁৎধষরুবফ ঢ়বৎংড়হং) নাগরিকত্ব রদ করার ব্যবস্থা করেছে এবং নির্দিষ্ট কিছু অপরাধ করলে এমনকি সেই অপরাধ যদি কানাডার বাইরেও ঘটে তাহলে দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব হরণ করার ব্যবস্থা করেছে। স্টারের ওকল্যান্ড রস সম্প্রতি রিপোর্ট করেছেন যে, শেষ পদক্ষেপটি এমনকি নেলসন ম্যান্ডেলারও কানাডায় বসবাসের সুযোগ পাওয়া আটকে দিতে পারে বলে মনে হয়।

কানাডার পরিচিতির সুনির্দিষ্ট করে দেয়া অভিবাসন নীতিতে কোনরকম মৌলিক পরিবর্তন আনতে হলে বিষয়টির ওপর পূর্ণাঙ্গও স্বচ্ছ জাতীয় বিতর্ক অনুষ্ঠানের প্রয়োজন রয়েছে। কানাডীয়রা কি সত্যিই চায় অভিবাসন নীতিতে নৈতিক দিক বিবেচনার পরিবর্তে বাস্তববাদিতাকেই সর্বোচ্চ স্থান দিতে? অভিবাসী বাছাই করার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবদানের বিষয়টিই একমাত্র বিবেচ্য হওয়া উচিৎ কি? কানাডা কেন অভিবাসীদের কানাডীয় হওয়ার বিষয়টি কঠিন করে তুলবে? দুর্ভাগ্যজনক যে, বিদেশী অস্থায়ী শ্রমিক এবং উদ্বাস্তুদের জন্য স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ প্রত্যাহারের বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক তোলপাড়ের পরও কোনরকম জাতীয় বিতর্ক হচ্ছে না।

তার পরিবর্তে আমাদের অভিবাসন ব্যবস্থায় এক ধরণের ডি-ফ্যাক্টো বিপ্­লবের ব্যাপারে কানাডীয়দেরকে একপেশে দৃষ্টিতে রাখা হয়েছে: যে বিপ্লবে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন কিছু আপাত নির্দোষ পরিবর্তনের সমষ্টি প্রান্তিকভাবে সম্পর্কিত বিল এবং প্রক্রিয়ার ভেতর এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে যেন নীতি-নৈতিকতা, ন্যায়বিচার এবং ভবিষ্যতের জন্য কানাডীয়রা যেধরণের সমাজ গড়ে তুলতে চায় ইত্যাদি বিষয়ের কোন সম্পর্কই নেই।

কানাডীয়রা হয়তো ততক্ষণ পর্যন্ত জানতেই পারবেন না যে এই বিপ্ল্লব ঘটে চলেছে যতক্ষণ পর্যন্ত না ভবিষ্যতে মাইপেক্সের কোন সমীক্ষার ফলাফলে এটা দেখানো হয় যে, কানাডার অভিবাসন প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা অন্যান্য দেশের তুলনায় নিুমুখি হয়ে পড়েছে। – সৌজন্যে : টরন্টো স্টার