অভিবাসন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিল সি-২৪ বৈষম্যমূলক এবং নাগরিকত্বকে দুর্বল করবে
অভিবাসন মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডার বলেছেন, বিল সি-২৪ কানাডার নাগরিকত্বকে জোরদার করবে
ডেবরা ব্ল্যাক, জুলাই ২৮, ২০১৪: অভিবাসন বিষয়ক রিপোর্টার : কানাডার নাগরিকত্ব জোরদারের লক্ষ্যে প্রণীত বিল সি-২৪ নিয়ে অটোয়া সরকার নাটকীয়ভাবে একটি নতুন ভাষ্য সংজ্ঞায়িত করেছে যাতে কানাডিয়ান হওয়ার অর্থ কী সে বিষয়টিকে রক্ষণশীল দলের কেন্দ্রীয় সরকারের বিশ্বদর্শনকে গোটা জাতির দেশপ্রেম, আইনের শাসন, সামরিক বাহিনী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর গুরুত্ব আরোপকারী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়েছে।
কিন্তু এটি করতে গিয়ে সরকার এমন বিতর্কের সূচনা করেছে যেটিকে কানাডার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক বলে দেখা হচ্ছে। নাগরিকত্ব কি মানুষের অধিকার নাকি একটি সুবিধামাত্র। কানাডার নাগরিকত্বকে কী অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে? কোন পরিস্থিতিতে এর যথাযথ মূল্য পুনরুদ্ধার করা যায়?
আর এই বিতর্ক দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকবে বলেই মনে হয় কারণ বিলটি এরই মধ্যে রাজকীয় সম্মতি অর্জন করেছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে নাগরিকত্ব ও অবিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডার টরন্টোর ফোর্ট ইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে যখন এই সংস্কারের বিষয়ে প্রথম ঘোষণা দেন তখন তিনি বলেছিলেন যে ‘‘কানাডার নাগরিকত্বের বিশাল মূল্য সংরক্ষণ ও জোরদার’’ করার লক্ষ্যেই এই আইন করা হচ্ছে। তিনি নাগরিকদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, ‘‘নাগরিকত্ব কোন অধিকার নয় এটি একটি সুবিধা।’’
তিনি আরও বলেন: ‘‘আমরা কানাডার নাগরিকত্বের মূল্য আরও জোরদার করছি, এটি তাদের সম্মানে যারা এই শহরকে রক্ষা করেছেন, যারা এর জন্য ভূমিকা পালন করেছেন এবং এখনও করে চলেছেন, তাদের সবার সম্মানে যারা যুদ্ধে আত্মত্যাগ করেছেন এবং এটি তাদের সম্মানে যারা নিজ নিজ উপায়ে এই মহান দেশটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন।’’
কিন্তু প্রস্তাবিত পরিবর্তনের মধ্যেÑ যার মধ্যে অবস্থানের শর্ত দীর্ঘায়িত করা, সম্ভাব্য নাগরিকদের কাছ থেকে তারা কানাডায় বসবাস করবেন মর্মে লিখিত বিবৃতি আদায়, কানাডার দাফতরিক ভাষার ওপর দখল থাকার বিষয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বয়সসীমা বাড়িয়ে দেয়া, নাগরিকত্ব হরণ করার ক্ষমতা বাড়ানো এবং আবেদনের প্রক্রিয়া সঙ্কুচিত করে আনার বিষয়গুলিকে সঠিক পদক্ষেপ বলে সবাই মনে করেন না।
এই আইনের সূচনাকাল থেকেই এটি ক্রমবর্ধমান সমালোচনার জন্ম দিয়েছে যার বেশিটাই আলোকপাত করেছে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়ে, নাগরিকত্বকে অধিকারের পরিবর্তে সুবিধা হিসাবে বিবেচনার নীতিগত অবস্থার পাল্টানোর বিষয়ে এবং নাগরিকত্ব হরণের ক্ষমতা সম্প্রসারণের বিষয়ে।
পারস্পরিক ক্রিয়া :
কানাডা উদ্বাস্তু বিষয়ক আইনজীবী সমিতি এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সিভিল লিবার্টিজ অ্যাসোসিয়েশন এক অনলাইন আবেদনের মাধ্যমে এই আইনের বিরুদ্ধে ৪২,০০০এর বেশি স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছে। আর বহু সমালোচক পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে উপস্থিত হয়ে এটিকে বৈষম্যমূলক এবং বহিঃস্কারমূলক (বীপষঁংরড়হধৎু) বলে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন।
টরন্টোর আইনজীবী রোকো গ্যালাটি এবং কনস্টিটিউশনাল রাইটস সেন্টার গত ২৫ জুন এই আইনের বিরুদ্ধে আইনগত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে এই বলে যে, বিল-২৪-এ নাগরিকত্ব হরণের যে বিধান করা হয়েছে তার সাংবিধানিক বৈধতা প্রশ্নে কেন্দ্রীয় আদালত রুল জারি করুক। কানাডার উদ্বাস্তু বিষয়ক আইনজীবী সমিতি, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ার লিবার্টিজ অ্যাসোসিয়েশন কানাডার অধিকার ও স্বাধীনতার সনদের ভিত্তিতে এই আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করার হুমকি দিয়েছে।
অনেক সমালোচক মনে করেন ক্রিস আলেকজান্ডার যাই বলে থাকুন না কেন, নাগরিকত্বকে অধিকতর বহিস্কারমূলক (বীপষঁংরড়হধৎু), বাধা সৃষ্টিকারী (বীপষঁংরাব) এবং ভঙ্গুর হবার কারণে এই নতুন আইন কার্যত কানাডার নাগরিকত্বকে দুর্বল করে তুলবে।
কিন্তু অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী এসব অভিযোগ দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘এখন যেমনটা করা হচ্ছে সেভাবে নাগরিকত্বের মূল্য কখনই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়নি। এটির মূল্য রয়েছে কারণ এটির নিয়ন্ত্রণে কিছু বিধিবিধান রয়েছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘কানাডায় নাগরিকত্বের সঙ্গে অবশ্যই অধিকার এবং পর্যাপ্ত সুবিধার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, কিন্তু সেটি কেবল তাদের জন্য আমরা যারা এখানে জন্মগ্রহণ করেছি এবং যারা স্বাভাবিকভাবে কানাডিয়ান (হধঃঁৎধষরুবফ ঈধহধফরধহং) তাদের জন্য প্রযোজ্য যার সঙ্গে দায়িত্বশীলতার যোগ রয়েছে।’’
আলেকজান্ডারের মতে, এই আইনের পক্ষে ব্যাপক জনগণের সমর্থন রয়েছে। অবশ্য ডেইলি স্টার থেকে অন্তত একডজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় যাদের সবাই একবাক্যে এই সংস্কারের বিরোধিতা করেছেন।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের প্রফেসর অড্রে ম্যাকলিন, যিনি অভিবাসন ও নাগরিকত্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ‘‘এসব সংস্কার নাগরিকত্ব পাওয়া কঠিন এবং হারানো সহজতর করবে।’’ তিনি বলেন, ‘‘আপনি যদি এমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন
যে, নাগরিকত্ব একটি পণ্য এবং আপনি এটিকে আরও মূল্যবান করে তুলতে চান তাহলে এটিকে দুর্লভ, পাওয়া কঠিন কিন্তু হারানো সহজ করে দিলে অন্য যে কোন পণ্যের মত এরও মূল্য বৃদ্ধি পাবে।’’
নাগরিকত্বকে অধিকার হিসাবে না দেখে সুবিধা হিসাবে দেখার এই নীতিগত পরিবর্তন এবং অভিবাসী ও স্বাভাবিকভাবে কানাডার নাগরিকদের জন্য এটি যে অর্থ বহন করে তাতে প্রফেসর ম্যাকলিন গভীরভাবে বিচলিত। তিনি বলেন, ‘‘সরকার যখন বলে নাগরিকত্ব একটি সুযোগ তখন তারা সত্যিই তাই বোঝায়। অর্থাৎ আমরা তোমাকে এটি দিতে পারি আবার কেড়েও নিতে পারি। এই বিল অন্য যা কিছুই করুক না কেন, নাগরিকত্বকে সুবিধা হিসাবে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গি কানাডার নাগরিকত্বকে আসলে দুর্বলই করবে। এটি বরং পারমানেন্ট রেসিডেন্ট-এর মর্যাদার উন্নত রূপ হয়ে উঠছে।’’
ম্যাকলিন বলেন, নতুন আইনে নাগরিকত্বকে একটি পুরষ্কার হিসাবে দেখা হবে যা খুব দ্রুতই ছিনিয়ে নেয়া যাবে যেহেতু এটি হরণ করার বর্ধিত ক্ষমতা অটোয়ার হাতে থাকছে।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘নাগরিকত্ব হরণের ক্ষমতা সব সময়ই ছিলো। আর সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিকত্ব ‘‘হরণ করা যেতো কানাডার নাগরিকত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত আচরণ বিধির কারণে: ভুয়া প্রতিনিধিত্ব, প্রতারণা বা তথ্য গোপন করা ইত্যাদি।’’ কিন্তু নতুন আইনে অটোয়াকে নাগরিকত্ব হরণের অধিকতর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যা হয়তো খুবই কঠোর এবং অনাকাঙ্খিত পরিণতির দিকে যেতে পারে।
ম্যাকলিন আশঙ্কা করেন যে, নতুন আইন অনুযায়ী যদি এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে, একজন ন্যাচারেলাইজড নাগরিক কানাডায় বসবাস সংক্রান্ত তার লিখিত বিবৃতিতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন তাহলে তার নাগরিকত্ব হরণ করে নেয়া হতে পারে।
তিনি বলেন, শুধু যে বিরাট সংখ্যক লোক ঝুঁকির মুখে পড়বেন সেটিই একমাত্র উদ্বেগের বিষয় নয় বরং এটি যে ভীতিকর প্রভাব সৃষ্টি করবে সেটিই উদ্বেগের বিষয়। এটি জনগণের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করবে এবং তাদের ইচ্ছামত জীবন পরিচালনার সক্ষমতা খর্ব হবে কারণ জানে না এই ক্ষমতা কীভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। কে জানে কাকে কী কারণে মন্ত্রী উদাহরণ সৃষ্টির জন্য বাছাই করবেন।’’
ম্যাকলিন আরও উদ্বিগ্ন একারণে যে, নাগরিকত্ব হরণের ক্ষমতা কারও মন্দ আচরণ বা অপরাধমূলক কর্মকান্ডের শাস্তি হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে। বিল সি-২৪ অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে এমন কোন নারী বা পুরুষ গুপ্তচরবৃত্তি, সন্ত্রাসবাদ, বিশ্বাসঘাতকতা বা কানাডীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মত গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকলে তার নাগরিকত্ব হরণ করা যাবে।
তার মতে এটি একধরণের দীপান্তর বা দেশ থেকে বের করে দেয়ার মতো ব্যাপার। তিনি বলেন, ‘‘এটি সম্পূর্ণ নতুন এবং এটি শাস্তির একটি ধরণ।’’ তিনি বুঝতেই পারেন না যে, অপরাধমূলক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আরও অনেক উপায় থাকতে এটিকে কেন আইনের মূল বিষয় করে তোলা হলো। আর তিনি নিজে এবং অন্য সমালোচকরা ভয় পাচ্ছেন যে, নাগরিকত্ব হরণের শঙ্কা থেকে কেউই নিরাপদ বোধ করবেন নাÑএমন কি যারা এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং জাতিসত্ত্বার কারণে যাদের ভিন্ন কোন দেশের দ্বৈত নাগরিক হওয়ার বৈধ অধিকার রয়েছে তারাও না।
কিন্তু আলেকজান্ডার এই বিশ্লেষণের সঙ্গে একমত নন। মন্ত্রী বলেন, ‘‘কানাডীয়রা তাদের নাগরিকত্বের মূল্য দেয়। তারা বোঝে যে, এটি তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা এখানে বসবাস করে এবং কানাডার সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি বিক্রি করার জিনিস নয়, এটি বিনামূল্যেরও নয় আর এটি কোনরকম দায়বদ্ধতামুক্তও নয়।…
‘‘আমরা যা বলছি তা হলো, ওইসব গুরুতর অপরাধ যা কেবল সন্তাসের সঙ্গে যুক্ত নয় বরং আনুগত্যের প্রশ্নে অপরাধ যেখানে আপনি প্রকৃতই একটি আদর্শকে গ্রহণ করছেন, অন্য কোন শক্তির আনুগত্য বরণ করে নিচ্ছেন অথবা বিশ্বের প্রতি বৈরি কোন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছেন তখন এগুলো কোন দ্বৈত নাগরিকের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব হরণের ভিত্তি হিসাবে বিবেচিত হবে।’’
কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করেন এই সংস্কারের পেছনে কোন বড় খেলা চলছে। উইলফ্রিড লরিয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ক্রিস এন্ডারসন যিনি নাগরিকত্ব ও অভিবাসনের ইতিহাস ও নীতির ওপর বিশেষজ্ঞ তার মতে, এই সংস্কার কানাডা ও নাগরিকত্ব সম্পর্কিত ভাষ্যের নতুন সংজ্ঞায়নে সহায়ক, এমন একটি সমাজ-রাজনৈতিক রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক যা আরও বেশি রক্ষণশীল, এমন একটি রাষ্ট্র যা সামরিক বাহিনী, আইনের শাসন এবং রাজতন্ত্রকে অধিকার ও স্বাধীনতার সনদ ও শান্তিরক্ষার ওপরে বরণ করে নেয়।
এন্ডারসন বলেন, ‘‘রক্ষণশীল নীতিকে অর্থবহ করতে হলে তাদেরকে কানাডিয়ান বলতে কী বোঝায় সেই অর্থ পরিবর্তন করতে হবে।’’ আর সেইসঙ্গে তাদেরকে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধিমালাও পাল্টাতে হবে। তিনি বলেন, বিল সি-২৪ তার কঠোরতর বসবাসের শর্ত, কানাডায় বসবাসের লিখিত বিবৃতি এবং অপব্যবহারের অভিযোগসহ একটি মৌলিক ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে যা ঠিক ফেয়ার ইলেকশন আইনের মতই।
নাগরিকত্ব ও অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী অবশ্য বলেন যে, অভিবাসন পদ্ধতিতে উল্লেখযাগ্য সমস্যা থাকার কারণেই এতে সংস্কার করা হচ্ছে। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে নাগরিকত্বের আবেদনপত্র ক্রমশ স্তূপীকৃত হয়ে ওঠা, নাগরিকত্বের বিষয়টিকে খর্ব করা এবং ব্যাপকভিত্তিক অপব্যবহার। শেষ দুটি সমস্যার সূচনা হয়েছে তার ভাষায় ১৯৭৭ সালে পিয়েরে এলিয়ট ট্রুডোর লিবারেল সরকারের সংস্কার নীতি থেকে।
তিনি বলেন, ‘‘ট্রুডোর আমলের সংস্কার নাগরিকত্বের বিষয়টিকে জলো করে ফেলা হয়। তারা এদেশে বসবাসের শর্ত ৫বছর থেকে কমিয়ে ৩ বছর করেন এবং ভাষার ওপর দখলের বিষয়টিকে সংক্ষিপ্ত করে ফেলা হয় যা আক্ষরিক অর্থে নাগরিকত্বের মূল্য ও এর অর্থবহতাকে বিষয়টিকে খর্ব করে দেখার দিকে ঠেলে দেয়।’’ আর এর ফলেই এই ব্যবস্থার ব্যাপকভিত্তিক অপব্যবহার শুরু হয় বলে মন্ত্র্রী দাবি করেন।
কিছু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেন, ঘটনা আসলে এমন নয়। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক ফিল ট্রিয়াডাফিলোপোলাস বলেন, ‘‘আমার মনে হয় তারা এমন সব বিষয়ে কথা বলছেন যে সমস্যা আদৌ বিদ্যমান নেই। আমার মনে হয় কানাডা জনগণকে পারমানেন্ট রেসিডেন্ট থেকে নাগরিকত্ব দেয়ার কাজটা ভালোভাবেই করে আসছিলো। … ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিক থেকে নাগরিকত্বের জন্য যেসব পূর্বশর্ত ঠিক করা হয়েছিলো তাতে ভুল কিছু দেখি না।… সরকারী নীতি হতে হবে ব্যর্থতার বিপরীতে। কিন্তু নাগরিকত্বের বিষয়ে আমাদের কোন ব্যর্থতা ছিলো না।’’
নাগরিকত্ব নিয়ে প্রতারণা এবং ভুয়া প্রতিনিধিত্বের ঘটনার সঠিক পরিমাণ পাওয়াটা বেশ কঠিন। পরিসংখ্যান ভিন্ন ভিন্ন। আলেকজান্ডার জানিয়েছেন, নাগরিকত্বের আবেদন ও পারমানেন্ট রেসিডেন্ট মর্যাদার বিষয়ে এ মুহূর্তে ১১হাজার তদন্ত চলছে।
তিনি জানান, ২০১১ সাল থেকে কয়েক ডজন লোকের নাগরিকত্ব হরণের ঘটনা ঘটেছে আর তিনি মন্ত্রী হবার পরও বেশ কিছু নাগরিকত্ব হরণ করা হয়। আরসিএমপির তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে, তারা ৩,০০০এর মতো কানাডীয় নাগরিকের রেসিডেন্স সংক্রান্ত প্রতারণার ঘটনা এবং ৫,০০০ পারমানেন্ট রেসিডেন্ট-এর বিষয়ে তদন্ত চালাচ্ছে। এসব পরিসংখ্যান থেকে সমালোচকরা অপব্যবহারের অভিযোগের বৈধতা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
টরন্টোর একজন অভিবাসন ও উদ্বাস্তু বিষয়ক আইনজীবী এবং উদ্বাস্তু বিষয়ক কানাডীয় অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি লোরনে ওয়াল্ডম্যান বলেন, ‘‘ রক্ষণশীল সরকার অভিবাসন বিষয়ে যা কিছু করেছে তার সবটাই করেছে এমন ধারণার প্রতিক্রিয়া থেকে যে লোকেরা প্রতারণা করছে। কানাডীয় জনগণের সামনে অব্যাহতভাবে যে বার্তা পৌঁছানো হচ্ছে তা হলো উদ্বাস্তুরা ভুয়া, অভিবাসীরা সন্ত্রাসী বা অপরাধী এবং এদেরকে দ্রুত অন্যত্র স্থানান্তর করা দরকার, নাগরিকত্বের জন্য আবেদনকারীরা মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে এবং প্রতারণা করছে।
ওয়াল্ডম্যানের ধারণা, নতুন আইনের মূল প্রোথিত রয়েছে যা তার ভাষায় একটি বিরাট মিথ্যার গভীরে।
অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর অ্যাপ্লায়েড এথিক্স বিষয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর প্যাটি লেনার্ড মি. ওয়াল্ডম্যানের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, প্রতারণার বিষয়টির ওপর সত্যিকার অর্থেই ব্যাপক জোর দেয়া হচ্ছে, কিন্তু সরকার বার বার এমন তথ্য উপাত্ত পরিবেশনে ব্যর্থ হচ্ছে যে, প্রতারণা আসলেই একটি সমস্যা।
‘সরকারী নীতি হলো ক্ষতি ও ভালোর মধ্যে ভারসাম্য বিধান করার বিষয়। আইনে যেসব পরিবর্তন আনা হচ্ছে তাতে কানাডার অভিবাসীদের প্রতি বিশ্বাসের অভাব এবং তাদের প্রতি অনুগত হতে ইচ্ছার অভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। প্রত্যেকেই স্বীকার করবেন যে, আমাদের সমাজ ওই বিসয়গুলোর ওপর নির্ভরশীল।’’
কানাডার নাগরিকত্বের বিষয়টি অপেক্ষাকৃত নতুন। ১৯৪৭ সালে নাগরিকত্বের আইন কার্যকর হবার আগপর্যন্ত এ বিষয়ে কোন ধারণা ছিলো না। ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের প্রফেসর যিনি নাগরিকত্ব, উদ্বাস্তু ও অভিবাসন বিষয় আইনে বিশেষজ্ঞ সেই ডোনাল্ড গ্যালোওয়ে বলেন, তখন এই আইনটিকে দেখা হতো কানাডার ঔপনিবেশিক মর্যাদা থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস হিসাবে।
প্রফেসর গ্যালোওয়ে বলেন, ‘‘বিল সি-২৪ একটি পশ্চাৎমুখি পদক্ষেপ যা আমাদেরকে একটি অন্ধকার যুগের দিকে নিয়ে যাবে যেখানে নাগরিকত্বের কোন নিরাপত্তা থাকবে না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সরকার যা করছে তা হলো, কানাডার নাগরিকত্বকে একটি মূল্যবান পণ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। কিন্তু আমাদেরকে কানাডীয় হিসাবে গর্বিত করে তোলার সময় নাগরিকত্ব পাওয়ার কঠোরতর শর্তাবলী পূরণে যারা সক্ষম নয় তাদেরকে প্রকৃতপক্ষে ভোটাধিকার বঞ্চিত রাখতে চাইছে।’’
বার্কেলেতে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং কানাডিয়ান স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান আইরিন ব্লোয়েমরাড-ও বিশ্বাস করেন, অভিবাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে সরকার যেসব সংস্কার এবং অন্যান্য পরিবর্তন আনছে তার লক্ষ্য হলো অভিবাসী নাগরিকত্বের ধারণা থেকে সরে গিয়ে ব্রিটিশ-কেন্দ্রীক মডেল অনুসরণ করা যেখানে নাগরিকত্ব কোন অধিকার নয় বরং এক ধরণের সুবিধা যা তোমাকে অর্জন করে নিতে হবে এবং সেটি অনুমোদন করার দায়িত্ব হলো সরকারের। এই পরিবর্তনে তিনি উদ্বিগ্ন।
ব্লোয়েমরাড আশঙ্কা করছেন যে, এসব সংস্কারের ফলে নবাগতদের প্রতি কানাডীয়দের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করতে পারে, অভিবাসীবিরোধী প্রবণতার দিকে চলে যেতে পারে যেমনটা ঘটেছে কোন কোন ইউরোপীয় দেশে এবং পরিণামে সেখানে বিদেশীদের প্রতি বিদ্বেষ ব্যাপকতর হয়ে উঠেছে ।
ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর লুইন গোল্ডরিং বলেন, বর্তমানে কানাডা হচ্ছে নেচারালাইজেশন পদ্ধতিতে নাগরিক হওয়ার সংখ্যার দিক দিয়ে সর্বোচ্চে। প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ আবেদনকারী নাগরিকত্ব লাভ করে। ২০০৩ থেকে ২০১৩ এই এক দশকে ১৯ লাখ অভিবাসী কানাডার নাগরিকত্ব পেয়েছেন।
তিনি মনে করেন, বিল সি-২৪-এর কারণে নেচারালাইজেশনের উচ্চ হারে পরিবর্তন আসতে পারে, নাগরিকত্বের দরোজা সঙ্কুচিত হতে পারে। কঠোরতর শর্তের কারণে শিক্ষার্থী, উদ্বাস্তু এবং বিদেশী সাময়িক কর্মীদের কানাডার নাগরিক হওয়ার স্বপ্ন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে পড়বে।
কিন্তু এ ধরণের উদ্বেগের বিষয়গুলি আলেকজান্ডারকে স্পর্শই করছে না। মনে হচ্ছে তিনি কানাডীয় হওয়ার মানে কী তার পুনর্লিখন এবং কানাডিয়ান নাগরিকত্ব ধারণ করার বিষয়টি বেশ উপভোগ করছেন।
বিল সি-২৪ নিয়ে দেশজুড়ে যে বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে সে বিষয়ে তিনি নিজে বা রক্ষণশীল দল কেউই চিন্তিত নন বলে মনে হচ্ছে। আলেকজান্ডার বলেন, ‘‘এই আইন আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেবে যে আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং কেন নাগরিকত্ব মূল্যবান। আমরা যখন নাগরিকদের দায়িত্ব বোধের কথা বলি তখন আমরা লাখো মানুষের পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করি যারা এখানে এসে কয়েক শতাব্দী ধরে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন এবং আমরা এখন বৈচিত্র্য উদযাপন করছি, শৃঙ্খলা জোরদার করছি এবং এখানে আইনের শাসন বিদ্যমান রয়েছে। আমরা একটি অত্যন্ত প্রাণবন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে অংশগ্রহণে নিজেদের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ।’’-সৌজন্যে: টরন্টো স্টার