সেরার সাফল্য পাওয়ার পর সবার প্রশংসায় ভাসছেন রোনাল্ডো
মোঃ সোহেল রানা : বিরুদ্ধবাদীরা বলে থাকেন অহঙ্কারী। শক্ত হৃদয়ের অধিকারী হিসেবেও পরিচিত। কিন্তু গত ১৩ জানুয়ারী ঠিক এর উল্টো চিত্রই দেখেছে গোটা বিশ্ব। ওইদিন সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ফিফা কংগ্রেসে ঘোষণা করা হয় ২০১৩ সালের ফিফা ব্যালন ডি’অর বিজয়ীর নাম। গুঞ্জন আর আলোচনার ডালপালার সমাপ্তি টেনে প্রত্যাশিতভাবেই ফিফা সেরা হয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলের মুখ থেকে সবার সেরা হিসেবে রোনাল্ডোর নাম উচ্চারিত হওয়ার পর তাঁর সুশ্রী মুখায়বটা যেন মায়াবী এক রূপে আবির্ভূত হয়েছিল। চেহারার অবয়বে সিআর সেভেনকে মনে হচ্ছিল নিষ্পাপ শিশু! কে বলবে, এই ছেলের মধ্যে দাম্ভিকতা আছে!! ব্যালন ডি’র হিসেবে পেলের মুখ থেকে নামটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাশের আসনে বসা বান্ধবীকে প্রথমে আবেগী চুম্বনে আবদ্ধ করেন। এরপর ছেলেকে নিয়ে যান বিজয়ী মঞ্চে। সেখানে যেয়ে অশ্রুর ঝন্যাধারা বয়ে দেন।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসি ও ফ্রাঙ্ক রিবেরিকে পেছনে ফেলে ২০১৩ সালের ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ফিফার সদর দফতর সুইজারল্যান্ডের জুরিখে জমকালো আয়োজনে রিয়াল মাদ্রিদের পর্তুগীজ তারকার নাম ঘোষণা করা হয়। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্লাটার ও উয়েফা সভাপতি মিশেল প্লাতিনি। কিছুদিন আগে কটাক্ষ করলেও ব্লাটারই রোনাল্ডোর হাতে সেরার পুরস্কার তুলে দেন। সেরা হওয়ার পথে রোনাল্ডো পেয়েছেন মোট ভোটের ২৭.৯৯ শতাংশ। দ্বিতীয় হওয়া বার্সিলোনার আর্জেন্টাইন সুপারস্টার মেসি পেয়েছেন ২৪.৭২ শতাংশ ভোট। বেয়ার্ন মিউনিখের ফরাসী উইঙ্গার রিবেরির ঝুলিতে জমা পড়ে ২৩.৩৬ শতাংশ ভোট। পয়েন্টের হিসেবে রোনাল্ডো ১ হাজার ৩৬৫, মেসি ১ হাজার ২০৫ ও রিবেরি পেয়েছেন ১ হাজার ১২৭ পয়েন্ট। ফিফা সদস্যভুক্ত প্রতিটি দেশের অধিনায়ক, কোচ ও মনোনীত সাংবাদিকরা ভোট দেন। তিনটি করে নাম মনোনীত করা যায়। প্রথম মনোনয়নের জন্য ৫ পয়েন্ট। দ্বিতীয় ও তৃতীয় মনোনয়নের জন্য যথাক্রমে ৩ ও ১ পয়েন্ট।
গত বছরজুড়ে ধারাবাহিক নজরকাড়া নৈপুণ্যের স্বীকৃতি হিসেবে ফিফা সেরার পুরস্কার পেয়েছেন রোনাল্ডো। এবার নিয়ে দুইবার তিনি এ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এর আগে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো ফিফা বর্ষসেরা হয়েছিলেন সিআরসেভেন। তবে ২০১০ সালে ফিফা বর্ষসেরা ও ব্যালন ডি’অর একীভূত করার পর এবারই প্রথম এই পুরস্কার পেয়েছেন পর্তুগাল জাতীয় দলের অধিনায়ক। ফের ফিফা সেরা হওয়ার পর গোটা ফুটবলবিশ্বের প্রশংসা ও অভিনন্দনের স্রোতে ভাসছেন সাবেক ম্যানইউ তারকা। গত চারবছর মেসির আড়ালে থাকা রোনাল্ডো পরবর্তী বছরেও শ্রেষ্ঠত্ব বগলদাবা করার ঘোষণা দিয়েছেন। রোনাল্ডোর ব্যালন ডি’অর জয়ের মধ্য দিয়ে বার্সিলোনার আর্জেন্টাইন জাদুকর লিওনেল মেসির একচ্ছত্র আধিপত্যের অবসান হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টানা চারবার ফিফা সেরার পুরস্কার জেতেন বার্সা ডায়মন্ড। কিন্তু গত বছর ইনজুরির কারণে প্রত্যাশিত নৈপুণ্য প্রদর্শনে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি এবার মুকুট হারিয়েছেন। তাঁকে হটিয়ে ফিফা ব্যালন ডি’অরের মর্যাদার মুকুট পড়েছেন রোনাল্ডো।
মেসির রাজত্ব কেড়ে নিয়ে সিংহাসনে বসা রোনাল্ডোর কৃতিত্বে কেঁদেছেন তার প্রেমিকা, মাসহ আত্মীয়স্বজন। নিজেও কেঁদে একাকার হন সিআর সেভেন। রোনাল্ডোর সঙ্গে তার প্রেমিকা ইরিনা শায়াকের কান্নার দৃশ্যটা সবার দৃষ্টি কাড়ে। রোনাল্ডোকে হয়ত এর আগে কখনোই এতটা আবেগী হতে দেখা যায়নি। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরস্কার নিতে গিয়ে বুঝতে পারিনি কেঁদে ফেলব। আমি অত কাঁদি না। আসলে যেমন কাঁদলাম, এতটা কান্না প্রথম প্রেমে ব্যর্থ হয়েও কাঁদিনি।’ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে রোনাল্ডো বলেন, ‘সবাইকে ধন্যবাদ। আমার সতীর্থ, জাতীয় দল, আমার পরিবার, এখানে যাঁরা এসেছেন, প্রত্যেককে। আমি আসলে কথা বলতে পারছি না।’ আবেগী হলেও দৃঢ়প্রত্যয়ী কণ্ঠে তিন নম্বর ব্যালন ডি’অর জয়েরও ঘোষণা দিয়েছেন রোনাল্ডো, ‘আমি নিজের সেরাটাই নিংড়ে দেব। বরাবর তাই করি। আশা করি পরের বার এখানে আবার ফিরে আসব আমার ক্যারিয়ারের তিন নম্বর ব্যালন ডি’অর জেতার জন্য।’ ব্যালন ডি’অর ট্রফি হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত রোনাল্ডো বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারা না। আমি সত্যিই আনন্দিত। এই পুরস্কার অর্জনের জন্য অনেক ত্যাগ আমাকে করতে হয়েছে। এছাড়াও আমি আরও ধন্যবাদ জানাতে চাই তাদেরকে যারা আমার ওপর আস্থা রেখেছে। সম্প্রতি মারা যাওয়া পর্তুগীজ কিংবদন্তি ইউসেবিও এবং দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা মাদিবাকে (নেলসন ম্যান্ডেলা) আমি এই অর্জনের মাধ্যমে আরেকবার শ্রদ্ধা জানাতে চাই। আমি যে এটা অর্জন করেছি এতে বিন্দুমাত্র কোন সন্দেহ নাই। পাশাপাশি এটাও বলব মেসি ও রিবেরিরও এটা পাওনা ছিল। প্রতিবারই ভিন্ন ভিন্ন আমেজে এই পুরস্কার সামনে আসে। কিন্তু দ্বিতীয়বারের এই অর্জনটা আমার কাছে আরও বেশি আবেগময়। কারণ মঞ্চে আমার সঙ্গে আমার মা এবং আমার ছেলে উপস্থিত ছিল।’ রোনাল্ডো বর্ষসেরার গৌরব পুনরুদ্ধার করেছেন মূলত জাতীয় দল পর্তুগালকে ব্রাজিল বিশ্বকাপের টিকেট পাইয়ে দিয়ে। ইউরোপীয় অঞ্চলের প্লেঅফের ম্যাচে সুইডেনের বিরুদ্ধে রোনাল্ডোর বিস্ফোরক নৈপুণ্যেই বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করে ইউরোপের ব্রাজিল। তাইতো ফিফা সেরা হওয়ার পর বিশ্বকাপেই দৃষ্টি রাখছেন সুদর্শন এই সুপারস্টার। এক সাক্ষাতকারে রোনাল্ডো বলেন, গত বছর আমি যা করেছি তাতে সন্তুষ্ট। এই ধারাবাহিকতা এই বছরও (২০১৪ সাল) অব্যাহত রাখতে চাই। কয়েক মাস পর ব্রাজিলে বিশ্বকাপ ফুটবল হবে। দেশের হয়ে এই বিশ্বকাপেও নিজের সেরাটা দিতে চাই। তিনি আরও বলেন, সবার মনের কোণেই থাকে বিশ্বকাপ জয়ের আকাংক্ষা। জানি বেশ কয়েকটি দল বিশ্বকাপ জয়ের জোর দাবিদার। কিন্তু আমাদের দলটারও সামথ্য আছে সর্বোচ্চ সাফল্য পাওয়ার। এ লক্ষ্যেই ব্রাজিলে খেলব আমরা।
এদিকে শ্রেষ্ঠত্ব হাতছাড়া হলেও রোনাল্ডোকে বেছে নেয়া সঠিক হিসেবে মন্তব্য করেন লিওনেল মেসি। তিনি বলেন, ‘ক্রিশ্চিয়ানোকে (রোনাল্ডো) আমি শুভেচ্ছা জানাতে চাই। ২০১৩ সালের বিচারে ক্রিশ্চিয়ানোর চেয়ে বিশ্ব সেরার পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য আর কেউ ছিল না। আমি ওকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি তো বটেই, রিবেরিও ওকে নিশ্চয়ই অভিনন্দন জানিয়েছে।’ তবে আর্জেন্টাইন অধিনায়ক মুখে যাই বলুন না কেন, তাঁর তিনটি ভোটের একটিও কিন্তু তিনি রোনাল্ডোকে দেননি। মেসির ভোট গেছে বার্সিলোনা সতীর্থ আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, জাভি হার্নান্দেজ ও নেইমারের বাক্সে। মেসি যেমন রোনাল্ডোকে ভোট দেননি, তেমনি রোনাল্ডোও পছন্দ করেননি মেসিকে। সিআরসেভেন যোগ্য মনে করেছেন যথাক্রমে মোনাকোর রাদামেল ফ্যালকাও, রিয়াল মাদ্রিদ সতীর্থ গ্যারেথ বেল ও সাবেক রিয়াল সতীর্থ আর্সেনালের মেসুত ওজিলকে।
সেরার সাফল্য পাওয়ার পর সবার প্রশংসায় ভাসছেন রোনাল্ডো। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলেও তার প্রশংসা করেছেন। তবে পরিপূর্ণ ফ্টুবলার হতে সিআরসেভেনকে আরও পরিশ্রম করতে হবে মত দিয়েছেন তিনটি বিশ্বকাপজয়ী তারকা। এ প্রসঙ্গে পেলে বলেন, ‘আমার চোখে বিশ্ব ফুটবলের শেষ কমপ্লিট ফুটবলার হলো জিনেদিন জিদান। টানা দশ বছর ও বিশ্বের সেরা ছিল। রোনাল্ডোকে ওই উচ্চতা স্পর্শ করতে গেলে অন্তত বিশ্বকাপ জিততেই হবে।’