বেনামী কবর
মীজান রহমান :
আকসা পারভেজের গল্পটি আমার মনে ছিল, নামটাই কেবল ভুলে গিয়েছিলাম। ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি পত্রিকায় একটা কলাম পড়ে মনে পড়ল। বেঁচে থাকলে ওই বছর মেয়েটার বয়স হতো ১৯। নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত, হয়তো টরন্টোর বাইরে কোনো শহরে, বাবা-মায়ের দৈনন্দিন শাসন থেকে দূরে। কিন্তু সে বেঁচে নেই। তাকে বাঁচতে দেওয়া হয়নি। ২০০৭ সালের ২০ ডিসেম্বর শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে তার বাবা ও ভাই তাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। হত্যার পর ওকে পুঁতে রেখেছিল একটা মাটির গর্তে। কবরে তার নাম-তারিখ কিছুই লেখা হয়নি। সে যে একদিন বেঁচে ছিল, তার কোনো চিহ্নই রাখতে দেয়নি তারা। অপরাধ? পত্রিকার খবরে এটুকুই শুধু লেখা ছিল যে, সে বাবার কড়া আদেশ অমান্য করে হিজাব না পরেই বাইরে বেরোত। আসল ঘটনা হয়তো আরও গভীর। পশ্চিমে বড় হওয়া অভিবাসী পরিবারের মেয়েদের সবচেয়ে বড় অপরাধ হিজাব না পরতে চাওয়া নয়, পশ্চিমের আর দশটা মেয়ের মতো করেই বড় হতে চাওয়া। হিজাব একটা প্রতীক মাত্র। প্রধান সমস্যা ‘পারিবারিক সম্মান’ (আমি একে বলি মানহারাদের মান রক্ষার মূর্খ প্রয়াস)। আকসা পারভেজ তার পরিবারের মান রক্ষা করেনি।
মানহত্যা বা অনার কিলিং ব্যাপারটি মুসলিম সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যদিও মুসলিম সমাজেই এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে আজকাল। বর্বর প্রথাটির সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই, যদিও মোল্ল্লারা কখনোই খুব জোরেশোরে এর বিরোধিতা করেননি। প্রথাটির প্রথম সূত্রপাত হয় প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে। পরিবারের অবাধ্য বা অসচ্চরিত্র মেয়েদের শাসন করতে না পারলে রোমান পুরুষদেরই শাস্তি দেওয়া হতো। দরকার হলে মৃত্যুদণ্ড। পরবর্তীকালের যাযাবর গোত্রগুলোর মাঝে প্রথাটি সরাসরি নারীদের ওপর বর্তিত হয়। চারিত্রিক স্খলন প্রমাণ হলে নারীকেই বহন করতে হতো শাস্তির ভার। চূড়ান্ত অপরাধের চূড়ান্ত শাস্তি। পুরাকালের প্রায় সব সমাজেই মানহত্যার প্রচলন ছিল অল্পবিস্তর। বর্তমান যুগে সেটা প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে -মুসলিম, হিন্দু ও শিখ। পশ্চিম বিশ্বে তাদের ব্যাপক অভিবাসনের ফলে সমসাময়িককালে পশ্চিমা জগতেও মানহত্যার খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রায়ই। যেমন কানাডা। কস্মিনকালেও কেউ শোনেনি এখানে ‘অনার কিলিং’ কাকে বলে। অথচ গত ১০ বছরে এখানে ১৩টি মানহত্যার খবর বেরিয়েছে।
‘অনার কিলিং’ শব্দ দুটি চয়ন করেছিলেন এনি নায়োটা নামক এক ডাচ্ গবেষক। তুর্কি সমাজের মেয়েদের জীবন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তাঁর মাথায় আসে শব্দ দুটি। সাম্প্রতিককালের ঘটনা সেটা, ১৯৭৮ সাল। অথচ প্রথাটি অনেকটা দাসত্বের মতোই পুরোনো। তুরস্কের মুসলিম সমাজে এর ব্যাপক প্রসার দেখে তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এতটা নৃশংসতা এ যুগেও বিরাজ করতে পারে সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর।
মজার ব্যাপার হলো, এই ‘নৃশংস’ প্রথাটি এখনো পুরোদমে বহাল আছে নানা দেশে। আন্তর্জাতিক জরিপে প্রকাশ, প্রতিবছর গড়ে পাঁচ হাজার মেয়ের প্রাণহানি হয় মানহত্যার কারণে। বেসরকারি সূত্রের মতানুসারে, প্রকৃত সংখ্যাটি তার চেয়ে অন্তত চার গুণ বেশি। এক পাকিস্তানেই কমপক্ষে এক হাজার মেয়ে প্রাণ হারায় প্রতিবছর। অন্য দেশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্ল্লেখযোগ্য হলো মিসর, জর্ডান, লেবানন, মরক্কো, সিরিয়া, তুরস্ক, ইয়েমেন ও ভারত। ২০০৮ সালের এক খবরে প্রকাশ, তুরস্কের সরকারি মানবাধিকার সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, এক ইস্তাম্বুল শহরেই প্রতি সপ্তাহে একটি মেয়ে মানহত্যার শিকার হয়। ভারতে খুব শোনা যায় না, কারণ সেখানে আইন খুব কড়া। পক্ষান্তরে জর্ডানে মানহত্যাকে বড় রকমের অপরাধ বলেই গণ্য করে না কেউ, ফলে শাস্তিটাও নামকাওয়াস্তে। বড়জোর বছর দুয়েকের কারাদণ্ড। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানহত্যাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষমতাবান পরিবার হলে তো কথাই নেই। পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে তারা। খবর চাপা দেওয়া কোনো সমস্যাই নয় তাদের জন্য। অন্যান্য দেশের তুলনায় পাকিস্তানের ছবিটাই বোধ হয় সবচেয়ে ভয়াবহ। জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনকালে শরিয়ার আইন প্রবর্তিত হয়েছিল দেশটিতে। তার পর থেকে সে দেশের মনুষ্যত্ব প্রায় নির্বাসিত। মানহত্যার দায়ে ধরা পড়লেও শাস্তি এঙানো এমন কোনো সমস্যা নয় সেখানে। আজকে মানহত্যার বিষয়টিতে পাকিস্তান হলো অবিসংবাদিত নেতা। সংখ্যার দিক থেকে একে হারানোর উপায় নেই। কী ভাগ্য আমাদের যে এই রুগ্ণ, বর্বর, অভিশপ্ত দেশটির সঙ্গে সব রকম রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে।
মানহত্যার দু-চারটি লোমহর্ষক ঘটনা বলি এবার।
তুরস্কের এক তরুণী। তার গুরুতর অপরাধ সে পশ্চিমা গান শুনতে পছন্দ করত। পরিবারের সন্দেহ তার ছেলেবন্ধু আছে। অবিবাহিত মুসলমান মেয়েদের ‘ছেলেবন্ধু’ থাকার চেয়ে ঘৃণ্য অপরাধ আর নেই। সত্য-মিথ্যা পরের ব্যাপার, শাস্তির জন্য সন্দেহই যথেষ্ট। পারিবারিক সম্মান রক্ষার খাতিরে তারা ওকে হত্যা করে। ২০১০ সালে একটি ১৬ বছরের মেয়েকে জীবন্ত, হ্যাঁ জীবন্ত, মাটিতে পুঁতে হত্যা করে তার আত্মীয়স্বজন ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করার অভিযোগে।
তুরস্কেরই আরেকটি ঘটনায় ১৩ বছরের এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে এক বয়স্ক পুরুষ। এর প্রতিকারস্বরূপ তার পরিবার তাকে বাধ্য করে ধর্ষকটিকে বিয়ে করতে। তারপর যখন সেই ধর্ষক স্বামী অন্য এক মেয়েকে ধর্ষণ করে জেলে যায়, তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তখন তার ওপর চাপ দিতে থাকে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করে অর্থোপার্জন করতে। তাতে অসম্মতি প্রকাশ করলে তারা তার ওপর বর্বরোচিত অত্যাচার চালায়, তার নাক-মুখ ক্ষতবিক্ষত করে চেহারা সম্পূর্ণ বিকৃত করে ফেলে। সে আইনের শরণাপন্ন হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি, কারণ এটাই নাকি ধর্ষিত মেয়েদের শাস্ত্রসম্মত শাস্তি! দোষটা পরিবারের নয়, তার নিজেরই!
আধুনিক প্রযুক্তি উন্নত জাতিগুলোকে হয়তো আরও উন্নত করে তুলছে, কিন্তু কোনো কোনো অনুন্নত জাতিকে করছে আরও অনুন্নত। উদাহরণ; ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে সৌদি আরবের একটি মেয়েকে খুন করে তার বাবা। ‘ফেসবুকে’ পরপুরুষের সঙ্গে আলাপচারিতা করার অপরাধে। ডেনমার্কের এক শহরে প্রকাশ্য দিবালোকে, জনবহুল রাজপথে, এক মুসলিম যুবতীকে গুলি করে হত্যা করে তার আপন ভাই। সঙ্গে ছিল মেয়ের লিভ-ইন বয়ফ্রেন্ড। মেয়েটি জানত তার জীবন বিপন্ন, তাই সে যথাসম্ভব চেষ্টা করত আত্মীয়স্বজনের চোখের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে ছায়ার মতো জীবন যাপন করতে। তার বাবা বা ভাই বোধ হয় শহরে ট্যাক্সি চালাত। আজকাল তো পশ্চিমের অধিকাংশ শহরেই মুসলিম ট্যাক্সিচালকের ছড়াছড়ি। মেয়ের বাবা তাদের অনুরোধ জানালেন, তাঁর মেয়েকে কোথাও দেখতে পেলে যেন তৎক্ষণাৎ সেলফোনে তাঁকে খবর দেওয়া হয়। এক মুসলিম পরিবারের সম্মান মানে সারা মুসলিম জাহানেরই সম্মান। ইসলামিক ব্রাদারহুড। ট্যাক্সিচালকেরা অতি উৎসাহের সঙ্গেই সেই অনুরোধে সাড়া দেন। যুবতীর হত্যার পেছনে তার ভাইয়ের হাত প্রত্যক্ষ হলেও পরোক্ষ হাত ছিল শহরের যাবতীয় ট্যাক্সিচালক গোষ্ঠীর। তারাই মেয়েকে বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে রাস্তায় হাঁটতে দেখার পর খবর পাঠায় ভাইয়ের কাছে। সেলফোন থাকাতে কত সুবিধা হয়েছে, তাই না?
বছর পাঁচেক আগে আমাদের অটোয়া শহরেই এক বীভৎস ঘটনা ঘটে গেল। ফিরোজ মঙ্গল ও খাদেজা সিদ্দিক দুই শিক্ষিত ও মুক্তমনা প্রেমিক-প্রেমিকা বিয়ে করে সংসারধর্ম শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সমস্যা একটাই, বিয়ের আগেই তারা বাসা ভাড়া করে একসঙ্গে থাকা শুরু করে স্বামী-স্ত্রীর মতো। মুসলিম পরিবারের জন্য দারুণ লজ্জার বিষয় সেটা, লোকের সামনে মুখ দেখানোর উপায় থাকে না। এর একটা বিহিত করা দরকার, নইলে পরিবারের মানরক্ষা অসম্ভব। সেই মানরক্ষার মহান দায়িত্বটি স্বহস্তে গ্রহণ করে খাদেজার সহোদর ভাই। একদিন তারা বাজার করতে বেরিয়েছিল এক শপিং সেন্টারে। গাডড়তে থাকাকালেই ভাই তাদের দুজনকে গুলি করে হত্যা করে। সৌভাগ্যবশত পশ্চিমের আইনকানুন ‘পারিবারিক সম্মানের’ ওপর ততটা গুরুত্ব দেয় না যতটা দেয় ন্যায়বিচারের ওপর। এখানে খুন মানে খুন, যে কারণেই হোক। তার শাস্তি হবেই। এই খুনটি যদি ওদের নিজেদের দেশে হতো তাহলে খুনি ভাইটিকে হাতকড়া না পরিয়ে হয়তো গলায় মালা দিয়ে সংবর্ধনা দিত লোকে। পশ্চিমের উদারপন্থী মুসলিমদের পরম দুশ্চিন্তার কারণ হলো যে উগ্রপন্থীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে তাদের প্রাণপ্রিয় শরিয়া আইনগুলো পশ্চিমেও চালু করা যায়। পশ্চিমের ধর্মীয় স্বাধীনতার সুযোগে তারা হয়তো সত্যি সত্যি শরিয়া আমদানি করে ফেলবে একদিন। তখন মুসলিম মেয়েদের অবস্থা কি দাঁঙাবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
মানহত্যা যে কেবল মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় তার দুয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া দরকার। মিস পাঠক এক গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। জাতবংশের ব্যাপারে সাংঘাতিক কড়া তার পরিবার। নিম্নবর্ণ দূরে থাক, একই বর্ণের নিম্নতর শ্রেণীর কারও সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক স্থাপন করতে তারা নারাজ। মেয়েটি বৃত্তি পেয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়তে যায়। বাবা-মায়ের সরাসরি নাগালের বাইরে। সেখানে একটি প্রচণ্ড রকম মেধাবী ছেলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়ে যায়, এবং সেটা ঘনাতে ঘনাতে একসময় গাঢ় প্রেমের আকার ধারণ করে। একই ধর্মের ছেলে এবং ভাগ্যক্রমে ব্রাহ্মণ বংশোদ্ভূত। আপাতদৃষ্টিতে আদর্শ যুগল। সমস্যা একটাই ব্রাহ্মণ হলেও একধাপ নিচু শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। সুতরাং পাঠক পরিবারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সেটা মিস পাঠক ভালো করেই জানত। তাই বাডড়তে খবর পাঠানোর চিন্তাই মাথায় আসেনি তার। গোপনে গোপনে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। আশা ছিল সময় আর রক্তের টান হয়তো একদিন বাবা-মায়ের মন গলাবে। কিন্তু তার আগেই একদিন মায়ের কাছ থেকে চিঠি আসে তার দিল্লির ঠিকানায়। কেমন করে খবর পেয়েছিলেন সে এক রহস্য। চিঠির মর্ম মায়ের খুব মন চাইছে মেয়েকে দেখতে। চিঠি পেয়ে মেয়ের মন গলে গেল। স্বামীকে সঙ্গে না নিয়ে একাই চলে গেল দেশের বাড়িতে। তারও খুব মন চাইছিল বাবা-মা-ভাইবোনদের দেখতে, অনেক দিন দেখেনি। প্রথম দিন বেশ ভালোই কাটল। প্রচুর জড়াজড়ি, গলাগলি আর কান্নাকাটি হলো, যা হয় সাধারণত। কিন্তু দ্বিতীয় দিন ভিন্ন ব্যাপার। সকালবেলা ওর ঘরে গিয়ে মা দেখলেন মেয়ের গা ঠান্ডা। কোনো সাড়াশব্দ নেই। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ, মুখ-কান সব নীল হয়ে আছে। তাঁর বিলাপ শুনে বাড়ির লোক সবাই এসে জড়ো হলো সেখানে। আস্তে আস্তে পাড়ার মানুষও ভিড় করে দাঁড়াল ওদের বাড়ির সামনে।
মিস পাঠক আত্মহত্যা করেছে। আগুনের মতো খবর ছড়িয়ে গেল চারদিকে, পুরো অঞ্চলে। মিস পাঠক বিষ খেয়েছে। কিন্তু কেন? লোকে উদগ্রীব হয়ে থাকে পুরো ঘটনা জানার জন্য। পুরো ঘটনা বের হয় পুলিশের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের পর। সর্বশেষ খবর, মিস পাঠক বিষ খেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু স্বেচ্ছায় নয়, মায়ের হাত ছিল তাতে। অর্থাৎ পরিবারের মানরক্ষার খাতিরে তার মা নিজেই মেয়ের জলের
গ্লাসে বিষ মিশিয়ে রেখেছিলেন!এক শিখ পরিবারের কথা আমি জানি। সব শিখ একই রকম গোঁড়া তা নয়, কিন্তু কট্টর গোঁড়াপন্থী শিখদের কাছ থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখাই মঙ্গল।
পরিবারটির এক ছেলে এক মেয়ে। তারা কানাডার পুরোনো অভিবাসী। মেয়েটি ভালো করেই জানত বিজাতীয় ছেলের সঙ্গে মাখামাখি করায় বিপদ আছে, পরিণতি ভালো না-ও হতে পারে। কিন্তু ভরা যৌবনে কেউ কি কখনো পেরেছে নিজেকে কড়া পাহারায় রাখতে? সেটা হয় না। নিষেধ যে আছে সেটা জানা এক কথা, মানা আরেক কথা। ও প্রেমে পড়ে গেল এমন এক ছেলের সঙ্গে, যার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের কোনো প্রশ্নই দাড়ায় না। একটি মুসলমান ছেলে। তবু তারা বিয়ে করে ফেলল গোপনে। গুটিকয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ছাড়া কেউ জানল না। তারপর পালিয়ে গেল দেশ ছেড়ে, অনেক অনেক দূরে, ছেলের গ্রামের বাডড়তে, যেখানে তার ক্রুদ্ধ পিতার গুপ্তচরেরা
খোঁজ পাবে না তাদের। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর তার শ্বশুরবাডড়র লোকেরা খুব আদর করেই তাকে বরণ করে নিল তাদের পরিবারে। এভাবে চলল তাদের সুখের দাম্পত্য জীবন। কেটে গেল অনেকগুলো বছর।
দুটি ছেলে হলো তাদের, একটি মেয়ে। তারাও কালে কালে কৈশোরে পৌঁছাল। শিখকন্যার পুরোনো জীবন দূর-অতীতের এক দুঃস্বপ্নময় স্মৃতির গর্ভে ডুবে রইল। সে জানত না যে তার অতীতের পরিবার কখনো ভোলেনি সে
অপমান। একবার তার স্বামী এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গেল পেপার পঙার জন্য। কেমন করে যেন সে খবর চলে যায় কানাডায় সেই ফেলে-আসা এবং প্রায় ভুলে-যাওয়া শিখ পরিবারের কাছে। গুপ্তচর আর গুপ্তঘাতক তো সব সময়ই মোতায়েন ছিল। একদিন হোটেল থেকে বেরোনোর পথে তার বুকে গুলি। ধরাধরি করে হাসপাতালে নিলেও তার জ্ঞান ফেরেনি। লাশ ফেরত পাঠানো হয় দেশে। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলেও এ ভয়টা সবসময়ই ছিল মেয়ের মনে, ওর বাবার রাগের সঙ্গে ভালোভাবেই পরিচিত সে।
আমাদের দেশে কি মানহত্যা আছে? ছিল না এবং এখনো হয়তো নেই, অন্তত প্রকাশ্যে। পাকিস্তানের চরম পশ্চাৎপদতা ও প্রাচীন গোত্রীয় মনোভাবের অভিশাপ সৌভাগ্যবশত আমাদের গায়ে লাগেনি তেমন। তবে জামায়াতের পাকিস্তানঘেঁষা মতবাদ ধীরে ধীরে সংক্রমিত করতে শুরু করেছে সাধারণ ধর্মভীরু বাংলাদেশিদেরও। তথাকথিত পারিবারিক সম্মানের খাতিরে দু-চারটে বীভৎস ঘটনা যে ঘটছে না আজকাল, তা নয়। ব্রিটেনের অভিবাসী সমাজে ঘটেছে গুটিকয় গত ১০-১২ বছরে। যাকে তারা সরাসরি ‘মানহত্যা’ বলছে না, বলছে ‘দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা’ কিংবা আত্মহত্যা। এভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা সবসময়ই ছিল আমাদের দেশে এবং বেশির ভাগ সময়ই তার প্রধান শিকার হয়েছে মেয়েরা। আমার ভয়, জামায়াত এবং মৌলবাদীরা তাদের শরিয়ার অস্ত্র দিয়ে আর না কি সর্বনাশ টেনে আনে বাঙালি নারীর জীবনে।
মীজান রহমান, গণিতবিদ
অটোয়া, কানাডা