বিভিন্ন পার্টি ও পিকনিকে ক্যাটারারদের সরবরাহকৃত খাবার কতটুকু নিরাপদ?

খুরশিদ আলম :

কানাডার বাঙ্গালী কমিউনিটিতে অনেকেই এখন বাসায় বসে ক্যাটারিং ব্যবসা করছেন। ব্যবসাটি বেশ জমে উঠেছে। কমিউনিটির পত্রিকাগুলোতেও এ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন এখন বেশ চোখে পড়ে। কিন্তু বিক্রির জন্য বাসায় বসে ক্যাটারিং বা খাদ্য প্রস্তুত করতে হলে সে বিষয়ে কানাডায় কিছু আইন রয়েছে। যাঁরা বাড়িতে বসে এই ব্যবসা করছেন তাঁরা কি সেই আইন মেনে চলেন? একটি সূত্র জানায়, টরন্টোতে ইতিমধ্যে কয়েকজন বাঙ্গালী ক্যাটারিং ব্যবসায়ীর বাড়িতে পুলিশ তল্লাসীও চালিয়েছে। তাহলে কি এই ক্যাটারিং ব্যবসায়ীরা আইন মেনে চলছেন না!। যদি তাই হয় তবে ক্যাটারিং ব্যবসা নামে বাসা বাড়িতে যে সব খাদ্য প্রস্তুত হচ্ছে তা খাওয়া আমাদের জন্য কতটুকু নিরাপদ তা ভেবে দেখা খুব জরুরী হয়ে উঠেছে বলে আমাদের মনে হয়।

বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কানাডায় রান্না করা অপরিচ্ছন্ন ও দুষিত খাবার খেয়ে যত লোক অসুস্থ হন তার বেশীরভাগই হয় রেস্টুরেন্ট বা ক্যাটারিং এর খাবার খেয়ে। এ দেশে গড়ে প্রতি বছর প্রায় ১৩ মিলিয়ন লোক অসুস্থ হয়ে পরেন এই অপরচ্ছিন্ন ও দুষিত খাবার খেয়ে। অতি সম্প্রতি প্রকাশিত কনফারেন্স বোর্ড অব কানাডার এক হিসেবে দেখা যায়, গতবছর শতকরা প্রায় ৯ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক লোক হোটেল রেস্টুরেন্ট বা ক্যাটারিং এর খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদের অসুস্থতার মাত্রা এতটাই বেশী ছিল যে কাজের জায়গায় সিক-কল করতে হয়েছিল। এভাবে ভুক্তভোগীদের কর্মঘন্টা নষ্ট, হাসপাতালের খরচ এসব মিলিয়ে এর ব্যয় দাড়ায় বছরে প্রায় ১.৩ বিলিয়ন ডলার। ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয়, কানাডায় খাবার দুষিত হওয়ার পিছনে যে ব্যাকটেরিয়াগুলো প্রধানত দায়ী সেগুলো হলো – সেলমোনেলা, ই.কোলাই, কেমপাইলোবেটার এবং ইরসিনা। এগুলো মাছ, মাংস, কাঁচা সবজি এবং বিভিন্ন রকমের ফলমূলে পাওয়া যায়।

আমরা লক্ষ্য করেছি গত কয়েক বছরে প্রবাসের বাঙ্গালীরা ক্যাটারিং এর খাবারের উপর বেশ নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন। প্রথম দিকে পিকনিক, জন্মদিন বা অন্য কোন সমাবেশে খাবার যোগান দেওয়ার জন্য লোকজন ক্যাটারিং ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হতেন। এখন দেখা  যাচ্ছে এই ক্যাটারিং এর খাবার প্রবাসীদের ডাইনিং টেবিলেও প্রবেশ করছে। বাড়িতে চার/পাঁচ ফ্যামিলি দাওয়াত দিলেও অনেকেই আপ্যায়নের জন্য ক্যাটারিং এর খাবার কিনে আনছেন। এর পিছনে নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। ব্যস্ততা এর অন্যতম একটি কারণ। কিছুটা আলস্যতাও রয়েছে। মেহমানদারীর জন্য রান্না-বান্না সহজ কাজ নয়। ঘরের কাপড়চোপড়, আসবাপত্র, কার্পেট ইত্যাদি তৈলাক্ত হয়ে উঠে। কাপড়ে মশলার গন্ধও একটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে আমাদেরকে যখন এলিভেটরে, বাসে বা ট্রেনে উঠি। কারণ আরো আছে। রান্না খারাপ হলে গৃহীনির বদনাম হয়। ক্যাটারিং এর খাবার হলে সেই ভয় থাকে না। অনায়াসেই ক্যাটারারদের উপর সেই বদনাম চাপিয়ে দেয়া যায়।

ঘরে তৈরী খাবারের চেয়ে ক্যাটারিং এর খাবার যে সস্তা তা কিন্তু নয়। বরং খরচ প্রায় দ্বিগুণ। প্রথম দিকে ক্যাটারিং ব্যবসায়ীরা বেশী অর্থ দাবী করতেন। প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়াতে খরচ এখন আগের তুলনায় অনেকটা কমে এসেছে। আর খরচ কমে যাওয়াতে  ক্যাটারিং এর গ্রাহক সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এই ক্যাটারিং এর খাবার কতটা পরিচ্ছন্ন এবং তা কতটা খাবারের উপযোগী। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে বিভিন্ন পিকনিকে ক্যাটারিং এর খাবার খেয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এর জন্য শুধু যে ক্যাটারারদের অবহেলা রয়েছে তা বলবো না। পিকনিকের ব্যবস্থাপনায় যাঁরা থাকেন তাঁদেরও গাফিলতি রয়েছে।

ক্যাটারারদের অবহেলার কথাই আগে বলা যাক। নিজ বাড়িতে বা এপার্টমেন্টে বসে যখন কেউ বিক্রির জন্য খাবার তৈরী বা রান্না করেন তখন অবশ্যই তাকে কিছু আইন মেনে চলতে হয়। কারণ এর সাথে ভোক্তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ক্যাটারারদের তৈরী খাবার খেয়ে কোন ভোক্তা যদি গুরুতর অসুস্থ্য হয়ে পড়েন এবং তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, তখন তাঁর ব্যয়ভার সরকার তথা টেক্সপেয়ারদেরকে বহন করতে হয়। যিঁনি অসুস্থ হলেন, ভোগান্তির পাশাপাশি তাঁর কর্মঘন্টা নষ্ট হয়। সর্বোপরি অপরিচ্ছন্ন ও দুষিত খাবার খেয়ে ফুডপয়জনিং হলে মানুষ মারাও যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ক্যাটারারের জেল জরিমানা দুই হতে পারে। সুতরাং ক্যাটারিং ব্যবসা মোটেও হালকা বা দায়িত্বহীন কোন ব্যবসা নয়। একারণেই এই ব্যবসা পরিচালনার জন্য তৈরী করা হয়েছে কিছু আইন যা এদেশে অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক।

অন্টারিও আইনে বলা আছে, বিক্রির জন্য বাসায় বসে যে কোন খাবার রান্না বা তৈরী করতে হলে ক্যাটারারকে অবশ্যই অন্টারিও খাদ্য আইন মেনে চলতে হবে। এই আইনের মধ্যে আছে খাদ্য কিভাবে রান্না করতে হবে, ফ্রিজে বা গরম ওভেনে রান্না করা খাদ্য কিভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, রান্নার পূর্বে খাদ্য কিভাবে স্টোরেজে সংরক্ষণ করতে হবে, বাজার থেকে ফ্রোজেন খাবার (মাছ, মাংশ, দুধ, দই ইত্যাদি) কিনে আনলে অথবা কোন সাপ্লাইয়ার কর্তৃক সরবরাহ করা হলে সেই খাদ্য কতক্ষণ বাইরে রাখা যাবে বা কতক্ষণের মধ্যে ফ্রিজে ঢুকাতে হবে ইত্যাদি। এছাড়াও ফ্রোজেন ফুডের প্যাকেটের গায়ে কোনরকম ড্যামেজ আছে কি না এসব যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেখতে হবে। প্যাকেটের গায়ে ড্যামেজ থাকলে সে খাবার ফেলে দিতে হবে।

যে স্থানে বা যে ঘরে রান্না করা হবে সেখানকার পরিস্থিতি ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রিত হতে হবে অন্টারিও আইন অনুযায়ী। ক্যাটারার যে ঘরে তাঁর নিজের জন্য রান্না-বান্না করেন সে ঘরে ক্যাটারিং এর খাবার তৈরী করা যাবে না। এর জন্য তাঁর প্রয়োজন হবে স্বতন্ত্র রান্নাঘর। সেই রান্নাঘর শুধু স্বতন্ত্র হলেই চলবে না, তাতে থাকতে হবে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা, রান্নায় ব্যবহৃত হাড়ি-পাতিল, চামচ ও অন্যান্য সামগ্রী যথাযথভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক সিঙ্কও থাকতে হবে। এর একটিতে থাকবে সাবানপানি, দ্বিতীয়টিতে এন্টিব্যাকটেরিয়াল লিকুইড মিশ্রিত পানি এবং তৃতীয়টিতে শুধু পানি যেমনটা থাকে রেস্টুরেন্টে। রান্নাঘরের দেয়াল, স্টোভ এগুলোও যথাযথভাবে পরিস্কার রাখতে হবে।

বাড়িতে ক্যাটারিং ব্যবসা করার জন্য স্বতন্ত্র যে রান্নাঘর তৈরী করা হবে সেটি আবার ফুড ইন্সপেক্টর এবং বিল্ডিং ইন্সপেক্টর কর্তৃক সার্টিফাইড হতে হবে। নিজের ইচ্ছামত বানালে চলবে না। আমরা জানি, রেস্টুরেন্টের কিচেনগুলো ফুড ইন্সপেক্টর এবং বিল্ডিং ইন্সপেক্টর কর্তৃক সার্টিফাইড করা থাকে এবং সেগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করে থাকেন সিটির ফুডসেফটি বিভাগের কর্মকর্তারা। কোন অনিয়ম পেলে সংশ্লিষ্ট রেস্টুরেন্টে তালা ঝুলিয়ে দেন ঐ কর্মকর্তারা। যতক্ষণ পর্যন্ত না উত্থাপিত অভিযোগগুলোর যথাযথ সমাধান করা হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ঐ রেস্টুরেন্টে তালা ঝুলতেই থাকে। কিন্তু বাসায় যাঁরা অনুমোদনহীন কিচেনে ক্যাটারিং করে থাকেন তাঁদের তালিকা সিটির ফুডসেফটি বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে থাকেনা। ফলে নিয়মিত পরিদর্শনের আওতার বাইরে থেকে যায় সেগুলো।

অন্টারিওতে যাঁরা এপার্টমেন্ট বিল্ডিং বা কন্ডোতে বসবাস করেন অন্টারিও আইন অনুয়ায়ী তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয় ক্যাটারিং এর জন্য আলাদা রান্নাঘর তৈরী করা। বিল্ডিং কর্তৃপক্ষ বা ম্যানেজমেন্টও সে অনুমতি দেয় না। সুতরাং এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এ বসবাস করে যাঁরা ক্যাটারিং ব্যবসা করে আসছেন সেটি কতটুক আইনসিদ্ধ তা তলিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ তাঁদের নেই স্বতন্ত্র রান্না ঘর, নেই পাশ করা ফ্লোর প্লান, নেই ভেন্টিলেশনের সুযোগ, নেই ফুড ইন্সপেক্টরের সার্টিফিকেট। ফলে তাদের তৈরী খাবার ভোক্তাদের জন্য কতটা নিরাপদ সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে। তাছাড়া টরন্টোর অধিকাংশ এপার্টমেন্ট বা কন্ডোতেই রয়েছে তেলাপোকার নির্বিঘœ আনাগোনা। ওষুধ দিলে কিছুদিন হয়তো তেলাপোকার আনাগোনাটা একটু কমে। কিন্তু শীঘ্রই তা আবার পুর্ণ্যদ্যমে চলতে থাকে। আজকাল যাঁরা ওষধ ছিটান তাঁরা সম্ভবত ভেজাল ব্যবসা শুরু করেছেন। কারণ তাঁদের ওষুধ ঠিক মত কাজ করে না। তাছাড়া, এপার্টমেন্টগুলোতে তেলাপোকার ওষুধ বলার সাথে সাথেই দেয়া হয় না। আর একবার দিলে পরবর্তী দেড় থেকে দুই মাস তাঁরা আর ওষুধ দিতে আসে না। খাবার দুষিত হওয়ার পিছনে এই তেলাপোকার একটি বড়রকমের ভূমিকা রয়েছে।

অন্যদিকে যারা বাংলো বা ডুপ্লেক্স টাইপ বাড়িতে থাকেন তাঁরা হয়তো বাড়িতে স্বতন্ত্র রান্নাঘর তৈরী করে নিতে পারেন। সে সুযোগ তাঁদের রয়েছে। তবে সেটি অবশ্যই ফুড ইন্সপেক্টর এবং বিল্ডিং ইন্সপেক্টর কর্তৃক সার্টিফাইড হতে হবে। সে সাথে বাকি নিয়ম-কানুন যা আছে সেগুলোও কঠোরভাবে পালন করতে হবে।

ক্যাটারারদের ফুড হ্যান্ডেলিং সার্টিফিকেট থাকাও অত্যন্ত জরুরী। রান্নাঘরে খাবার কি ভাবে রক্ষনাবেক্ষণ করতে হবে সেটি যদি তাঁরা না জানেন তবে অনেক খাবারই তাঁরা নষ্ট করতে পারেন। আর এ বিষয়ে যদি জ্ঞান না থাকে তবে নিজের ব্যবসারই যে ক্ষতি হয় তা নয়, ভোক্তাদের স্বাস্থ্যও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। রান্নাঘরের টাওয়েলের কথাই ধরা যাক। নিয়ম অনুযায়ী একটি ধোয়া টাওয়েল রান্নার কাজে দুই ঘন্টার বেশী ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ কাঁচা বা রান্না করা খাদ্যসামগ্রীর সংস্পর্ষে আসার দুই ঘন্টা পর থেকে এতে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া জন্মতে থাকে। সুতরাং চার/পাঁচ ঘন্টা বা তারো বেশী সময় ধরে যদি সেই একই টাওয়েল ব্যবহার করা হয় তাতে খাদ্যসামগ্রী দুষিত হওয়ার ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। হাঁচি বা কাশি দেয়ার সময়ও ক্যাটারারদেরকে খুব সতর্ক থাকতে হয় যাতে তা কোনভাবেই খাবারের উপর নিক্ষিপ্ত না হয়। অনেকে গরম খাবার ঠান্ডা করার জন্য তাতে ফু দিয়ে থাকেন। এটি অত্যন্ত খারাপ একটি অভ্যাস এবং ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ। কারণ মানুষের মুখের ফু এর সঙ্গে ব্যাকটেরিয়াও পরিবাহিত হয়। কেউ কেউ রান্না করার সময় বা রান্না শেষ করে তরকারীর লবন বা ঝাল পরখ করে দেখার জন্য চামচে করে একটু ঝোল নেন। সেই ঝোল আঙ্গুলের মাথায় লাগিয়ে জিভ দিয়ে পরখ করেন অথবা চামচ থেকে সরাসরি মুখে দিয়ে পরখ করেন। এই প্রক্রিয়াটি দুই থেকে তিনবার করা হয়। ফলে মুখের লালা ইতিমধ্যে ঐ চামচের ঝোলে মিশ্রিত হয়ে যায় এবং এই লালামিশ্রিত অবশিষ্ট ঝোলটুকু ফেলে না দিয়ে অনেকেই তা তরকারীর মধ্যে ঢেলে দেন। কেউ কেউ আবার চামচ ব্যবহার না করে সরাসরি আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেন তরকারীর মধ্যে। এই কাজগুলো যাঁরা করেন তাঁরা তার পরিনতি না জেনেই করেন। ফুডসেফটি সম্পর্কে তাঁদের নূন্যতম জ্ঞান থাকলেও তাঁরা এই কাজগুলো করতে পারতেন না। অনেকে আবার কাটিং বোর্ডে কাঁচা মাছ বা মাংস কাটার পর সেটি যথাযথভাবে না ধুয়েই তার উপর সালাদের আইটেম বা ফল-মূল কাটেন। ধোয়ারও রকম ফের আছে। অনেকে মনে করেন পানিতে ভিজালেই ধোয়া হয়ে গেল। কিন্তু ব্যাপারটি তা নয়। সাবানপানি দিয়ে খুব ভাল করে মেজে ঘষে ধুতে হয় কাটিং বোর্ড। কাটিং বোর্ড অনেকদিন ব্যবহারের ফলে তাতে স্থানে স্থানে ক্ষত বা গর্ত সৃষ্টি হয়। এই গর্তগুলো ভাল করে পরিষ্কার না করলে ব্যাকটেরিয়া তাতে আটকে থাকতে পারে। আবার যে ছুরি দিয়ে কাঁচা মাংস কাটা হয় সে ছুরি ভাল করে না ধুয়ে এবং জীবানুমুক্ত না করে সালাদ কাটা কোনভাবেই উচিৎ নয়। কারণ কাঁচা মাছ মাংসে সেলমোনেলা নামক ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াসহ আরো অনেক রকম ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে যা মানুষের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। অন্যদিকে রান্নার পর খাবার বাইরে রাখলে সাধারনত দুই ঘন্টা পর থেকেই তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মনো শুরু করে। সময় যত গড়িয়ে যায় ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যাও ততই বাড়তে থাকে। এখন একজন ক্যাটারার যদি কোন পিকনিক পার্টির জন্য সকালে রান্না শুরু করেন এবং সেই খাবার পিকনিকস্থলে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায় তখন সেই খাবার কতটা স্বাস্থ্যসম্মত থাকে? কানাডার সামারে বাইরের তাপমাত্রা ও বাতাসের আদ্রতা থাকে বেশী। এই তাপ ও আদ্রতা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে আরো ত্বরান্বিত করে।  আর দেখা গেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাবার দুষিত হয় রান্নার পর যখন এগুলো নড়াচড়া করা হয়। ক্রসকন্টামিনেশন এই সময়ই বেশী ঘটে। হাতের ময়লা, টাওয়েলেরর ময়লা, হাড়িপাতিল বা অন্যান্য কনটেইনার অপরিষ্কার হলে তার ময়লা খাবারে লেগে খাবার দুষিত হয়। সুতরাং এই সময় খুব সতর্কভাবে কাজ করা উচিৎ। আর রান্না করার সময় বাথরুম ব্যবহার করলে হাত অবশ্যই ভাল করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এ  নিয়মগুলো বাসায় বসে যাঁরা ক্যাটারিং করেন তাঁদের যেমন কঠোরভাবে মেনে চলতে হয় তেমনি যাঁরা রেস্টুরেন্টে কাজ করেন তাঁদেরকেও কঠোরভাবে মেনে চলতে হয়।

এবারে আসা যাক ভোক্তাদের প্রসঙ্গে। খাবারের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য ভোক্তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে প্রচুর। কেবল রেস্টুরেন্ট কর্মী  বা ক্যাটারারদের উপর দায় চাপিয়ে দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। মনে রাখতে হবে অপরিচ্ছন্ন বা দুষিত খাবার খেলে ভোগান্তিটা প্রধানত হয় ভোক্তাদেরই। একজন ভোক্তা যখন কোন ক্যাটারারের কাছ থেকে খাবার কিনতে যাবেন তখন তাঁরই পরখ করে দেখা উচিৎ ক্যাটারারের রান্না ঘরের পরিবেশ কি, ক্যাটারিং ব্যবসা পরিচালনা করার কোন লাইসেন্স বা অনুমোদন আছে কি না, তিনি কতদিন ধরে এ ব্যবসা করছেন, তাঁর সরবরাহকৃত খাবার খেয়ে ইতিপূর্বে কেউ অস্স্থু হয়েছেন কি না, তিনি কি বাজারদর থেকে খুব সস্তায় খাবার সরবরাহ করছেন কি না ইত্যাদি।

‘সস্তার তিন অবস্থা’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। তাই কোন জিনিষ সস্তা হলেই মনে রাখতে হবে তাতে কোন গলদ বা ঘাটতি আছে। আর ক্যাটারারদের কাছ থেকে যখন খাবার ডেলিভারী নেয়া হয়, সেই সময় থেকে শুরু করে পরে মেহমানদেরকে পরিবেশন করার মাঝখানে যে সময়টুকু ব্যয় হয় সেই সময়টুকুও বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখতে হবে। আগেই উল্লেখ করেছি, রান্না করার পর খাবার ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দিলে সাধারনত দুই ঘন্টা পর থেকেই তাতে ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে থাকে। সুতরাং রান্না করা খাবার ডেলিভারি নেয়া ও মেহমানদেরকে পরিবেশনের মধ্যখানের সময় যত দীর্ঘায়িত হবে খাবারের দুষণমাত্রা ততই বাড়তে থাকবে। বাড়িতে মেহমান দাওয়াত দিলে খাবার ওভেনে বা মাইক্রোওভেনে দিয়ে যথাযথভাবে গরম করে নেয়ার একটি সুযোগ আছে যদি সে খাবার ইতিমধ্যেই নষ্ট না হয়ে থাকে। এতে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে নেয়া যায়। কিন্তু বাইরে কোন পিকনিক বা অন্যকোন উৎসবে ক্যাটারারদের কাছ থেকে আনা খাবার পরিবেশন করতে গেলে সেই সুযোগ থাকে না। আর প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় ব্যবস্থাপকদের অব্যবস্থাপনার কারণে পিকনিকে খাবার পরিবেশন করা হয় অনেক দেরিতে। খাবার দেরীতে পরিবেশন করলে মেহমানদের অসুস্থ্য হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেক সময় উপস্থিত সকলের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে বেঁচে যাওয়া খাবার ফেলে রাখা হয় অযতেœ। যাঁরা দেরীতে আসেন তাঁরা পরে সেসব খাবার খেয়ে নেন। এক্ষেত্রে দেরীতে আসা ঐ মেহমানদের অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাটা থাকে আরো বেশী । আর যদি তাঁরা সত্যি অস্স্থু হন তবে এক্ষেত্রে ক্যাটারারদের দোষ দেয়ার কোন সুযোগ নেই। দায়ভার তখন হোস্ট বা পিকনিকের ব্যবস্থাপকদের। সুতরাং, ক্যাটারারদের পাশাপাশি হোস্টদেরও দায়িত্ব রয়েছে পরিবেশনের আগে খাবার যাতে নষ্ট না হয়ে যায় সেদিকে খেয়াল রাখা।

কানাডায় আমরা যারা এশীয় বা আফ্রিকান ইমিগ্রেন্ট তাঁদের নিজ নিজ জন্মভূমিতে ফুড সেফটির বিষয়টিকে অনেকেই জোক বা তামাশা মনে করেন। কানাডায় এসেও আমাদের অনেকে সেই ধ্যানধারণা নিয়েই বসবাস করছি। তবে বাস্তবতা হলো, আমেরিকার মত একটি উন্নত দেশেও প্রতিবছর প্রায় তিন হাজার মানুষ মারা যান দুষিত খাবার খেয়ে যেগুলো কোন না কোনভাবে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্ষে এসে দুষিত হয়। এ তথ্য আমেরিকার ‘সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন’ এর।  আমরা যে সব অনুন্নত দেশ থেকে এসেছি সেসব দেশে খাদ্যে দুষণের মাত্রা নিয়ে কারো কোন মাথাব্যাথা নেই, নেই কোন পরিসংখ্যান। ফলে সেখানে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তা মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠে না। এখন আমরা কানাডায় আছি। তাই আমাদের প্রত্যেকেরই উচিৎ কানাডার আইন মেনে চলা। আর এই মেনে চলা আমাদেরই স্বার্থে।

খুরশিদ আলম

সম্পাদক ও প্রকাশক , প্রবাসী কন্ঠ