নতুন সরকার ক্ষমতায় : এবার দূর হোক ইমিগ্রেন্টদের প্রতি বৈষম্য
সদ্য সমাপ্ত কানাডার জাতীয় নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপারের হারের পর পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্রই যেন এক মুক্তির আবহ বিরাজ করছে। খোদ রক্ষণশীল দলের লোকেরাও হারপারের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে রক্ষণশীল দলের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত প্রভাবশালী দৈনিক গ্লোব এন্ড মেইল পত্রিকার সম্পাদকীয়তেও হারপারের প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়েছিল। পত্রিকাটি কনজারভেটিভ পার্টিকে সমর্থন দিলেও ঐ সময় দলের প্রধান হারপারকে সমর্থন দেয়নি। স্পষ্টভাবেই বলে দিয়েছিল – কনজারভেটিভ পার্টি আরেকবার বিজয় প্রাপ্য কিন্তু স্টিফেন হারপার নয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান হারপারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল। তিনি ক্ষমতাকে তাঁর অফিসের মধ্যে কেন্দ্রিভূত করে রেখেছিলেন। স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও রয়েছে। এমপিদের কোনঠাসা করে রেখেছিলেন। বিল সি-৫১ এবং বিল সি-২৪ পাশ করিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হন তিনি। নিকাব ইস্যু নিয়ে চুড়ান্তমাত্রায় বিতর্ক সৃষ্টি করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও কানাডার শান্তিপূর্ণ ভাবমূর্তিকে নষ্ট করেন যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদারী করতে গিয়ে।
স্টিফেন হারপারের শাসন আমলে ইমিগ্রেশন পলিসিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয় যা সব বিবেচনায়ই ছিল কানাডার জাতীয় অগ্রগতির জন্য অমঙ্গলজনক এবং ইমিগ্রেন্টদের জন্য অবন্ধুসুলভ।
হারপার সাকারের অবিবেকী ইমিগ্রেশন পলিসির কারণে কানাডায় যারা ইমিগ্রেন্ট হয়ে এসেছেন তাদের মধ্যে নাগরিকত্ব লাভের হার নাটকীয়ভাবে কমে যায়। শতকরা ৭৯ ভাগ থেকে নেমে তা দাড়িয়েছে শতকরা ২৬ ভাগে।
অন্যদিকে হারপার সরকারের আমলে তার ইমিগ্রেশন মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডারসহ কনজারভেটিভ দল শুরু থেকেই তাদের নতুন প্রবর্তিত এক্সপ্রেস এন্ট্রি সিস্টেম নিয়ে বড়াই করে আসছিলেন। কিন্তু পরে দেখা গেল সেই বড়াই করা সিস্টেমে ১১২,৭০০টি আবেদন পত্রের মধ্যে মাত্র ৮৪৪ জন ইমিগ্রেশন পেয়েছেন গত জুলাই পর্যন্ত। এই ৮৪৪ জনের মধ্যে সবাই আবার প্রিন্সিপাল এপ্লিকেন্ট নন। প্রিন্সিপাল এপ্লিকেন্টদের ফ্যামিলি মেম্বারসহ ৮৪৪ জন। এদের মধ্যে গত জুলাই পর্যন্ত কানাডা পৌঁছেছেন ৪১১ জন।
উল্লেখ্য যে, সাবেক সরকারের ইমিগ্রেশন মন্ত্রী ক্রিস আলেকজান্ডার ক্ষমতায় থাকা কালে বলেছিলেন, “কানাডার সিটিজেনশীপ কোন অধিকারের বিষয় নয়, এটি একটি সুযোগ বা সুবিধা।” মন্ত্রির এই বক্তব্যও ছিল ইমিগ্রেন্টদের জন্য চরম অমর্যাদাপূর্ণ। আমরা জানি, যে সকল ইমিগ্রেন্ট নাগরিকত্ব লাভ করেন তারা কানাডার চার্টার অব রাইটস এন্ড ফ্রিডম দ্বারা সুরক্ষিত। কানাডার বিভিন্ন নির্বাচনে তারা ভোট দেওয়ার অধিকারী এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করতে পারেন। তারা কানাডার পাসপোর্ট বহন করতে পারেন।
সদ্য ক্ষমতাচ্যুত কনজারভেটিভ পার্টি ইমিগ্রেন্টদের নাগরিক অধিকারকেও নড়বড়ে করে তুলেছে এক কালো আইন তৈরী করে যার নাম বিল সি-২৪। ঐ আইনে সরকার ইচ্ছে করলে কানাডায় যারা দ্বৈত নাগরিক তাদের কানাডীয় নাগরিকত্ব বাতিল করে দিতে পারে। নতুন এই নাগরিকত্ব আইন কানাডায় দুই স্তরের নাগরিকত্ব সৃষ্টি করেছে। যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে তাদের বেলায় এই আইন বৈষম্যমূলক। এই আইন কানাডার চার্টার অব রাইটস এবং ফ্রিডমস এরও লংঘন।
কানাডার সিভিল রাইটস গ্রুপস এবং এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও মনে করে নতুন এই আইন দ্বৈত নাগরিকদের জন্য বৈষম্যমূলক। এর মাধ্যমে দ্বৈত নাগরিকদেরকে এক অর্থে ‘লেস কানাডিয়ান’ কাতারে ফেলা হয়েছে এবং কানাডায় জন্ম নেয়া নাগরিকদের চেয়ে কম অধিকারসম্পন্ন করে তোলা হয়েছে। বৃটিশ কলম্বিয়ার সিভিল লিবার্টিজ এসোসিয়েশন এর ভাষ্য মতে দ্বৈত নাগরিকরা এখন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে গেল।
সাবেক হারপার সরকার নির্বাচনে পরাজিত হবার আশংকা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য আরো একটি কালো আইন তৈরী করে যা বিল সি-৫১ নামে পরিচিত। এর আরেক নাম সন্ত্রাস বিরোধী আইন। ইসলামোফোবিয়াকে কাজে লাগিয়ে এই আইনের মাধ্যমে সাবেক হারপার সরকার ভেবেছিল নির্বাচনে জিতে যাবে। কিন্তু তাদের সেই আশা পূরণ হয়নি।
আমরা জানি বিল সি-৫১ আইনে অতিমাত্রায় কিছু অস্পষ্ট বাক্য রয়েছে যা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এর অপব্যবহারের মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন এই আইন সন্ত্রাস এর বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে না। বরং কানাডিয়ানদের নাগরিক অধিকারকে খর্ব করবে। এই আইন উপকারের চেয়ে অপকার করবে বেশী। মোদ্দা কথা, এটি সবার জন্যই একটি হুমকী হয়ে দেখা দিবে।
আইনটি পাশ হওয়ার আগে যে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এর বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে আছেন কানাডার সাবেক ৪ প্রধানমন্ত্রী জন ক্রেশ্চিয়েন, পল মার্টিন, জো ক্লার্ক এবং জন টার্নার। সুপ্রিম কোর্টের ৫ জন জাজও ছিলেন বিরোধিতাকারীদের মধ্যে। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারো কথাই শুনেননি। তিনি এটিকে আইনে পরিনত করেছেন।
কিন্তু তারপরও স্টিফেন হারপারের শেষ রক্ষা হয়নি। ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতেই হলো তাকে। এমনকি দলের নেতৃত্ব থেকেও তাকে বিদায় নিতে হয়েছে।
এখন ক্ষমতায় লিবারেল পার্টি। দলটিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য ইমিগ্রেন্টদেরও বড় ভূমিকা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এই দলের প্রতি ইমিগ্রেন্টদের কিছু দাবী রয়েছে। তাছাড়া নির্বাচনে জয়ী হবার আগে দলটি যেসকল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার মধ্যে এই বিতর্কিত বিল সি-২৪ বাতিলের কথাও ছিল। প্রতিশ্রুতি ছিল আরেক বিতর্কিত বিল সি-৫১কে সংশোধন করা হবে যাতে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার ব্যহত না হয়, ব্যহত না হয় বাক স্বাধীনতা। ইমিগ্রেন্টদের ক্রিডেন্সিয়াল যাতে কানাডায় যথাযথভাবে স্বীকৃত হয় কোনরকম অহেতুক বিলম্ব ছাড়া সে বিষয়েও প্রতিশ্রুতি ছিল। সর্বপোরি ইমিগ্রেশন আইনকে হারপার সরকার যে কঠিন অবস্থায় নিয়ে গেছে তা সংশোধনেরও প্রতিশ্রুতি ছিল লিবারেল দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে।
আমরা আশা করবো জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বে লিবারেল পার্টি তাদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিগুলো একে একে পুরণ করবে এবং দেশের অর্থনীতিকে মজবুত করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তা সবই করবে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে দেশটির নিরপেক্ষ মর্যাদা পুনরুদ্ধার করবে।