যারা প্রকৃত মুসলমান তারা জঙ্গীবাদ সমর্থন করে না
প্রবাসী কন্ঠ : গত বছর জুলাই মাসে বুলগেরিয়াতে এক জঙ্গী হামলার শিকার হয়ে ৫ জন ইসরাইলী পর্যটক নিহত হন। এ বছর জানুয়ারী মাসে সাহারা মরুভূমিতে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন কেন্দ্রে ইসলামী জঙ্গীরা হানা দিয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের বেশকিছু নাগরিককে পণ-বন্দি করেছিলেন। সেই বন্দিদের উদ্ধার করতে গিয়ে আলজেরিয়া সরকার এক কামান্ডো অভিযান চালায়। এতে পণ-বন্দি ও জঙ্গী উভয়পক্ষের বেশকিছু লোক নিহত হন। বুলগেরিয়া ও আলজেরিয়ার ঐ জঙ্গী হামলা দুটির সাথে কয়েকজন কানাডার নাগরিক জড়িত আছেন বলে প্রমান পাওয়া গেছে। ঐ দুটি ঘটনার পর আন্তর্জাতিক মহলে কানাডা এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। এই অবস্থায় কানাডা সরকার নতুন এক আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে বলে সাবেক ইমিগ্রেশন মন্ত্রী জেসন কেনী জানিয়েছিলেন। আইনটি পাশ হলে দ্বৈতনাগরিকত্ব আছে এমন কানাডিয়ানরা অন্যদেশে গিয়ে সন্ত্রাস বা সহিংসতায় জড়িত হলে নাগরিকত্ব হারাবেন।
এদিকে কানাডার ম্যাগডোনাল্ড লরিয়ার ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত সম্প্রতিক এক জরীপ রিপোর্ট থেকে জানা যায়,
কানাডার শতকরা ৬৫ ভাগ মুসলমান ইসলামী জঙ্গী সংগঠনের কার্যক্রম পছন্দ করেন না। তবে শতকরা ৩৫ ভাগ মুসলমানের সমর্থন রয়েছে ইসলামী জঙ্গী সংগঠনগুলোর কার্যক্রমের পক্ষে।
জরীপে প্রকশিত এই তথ্য যদি সঠিক বলে ধরে নেই তবে নিশ্চিতভাবেই তা একটি দুর্ভাবনার বিষয়। দুর্ভাবনা শুধু কানাডীয় সরকারেরই নয়, এখানে যারা সাধারণ মুসলমান আছেন তাঁদেরও জন্যও এটি একটি দুর্ভাবনার বিষয়।
আমরা জানি কানাডায় প্রায় সাড়ে নয় লাখ মুসলমান বাস করে (সূত্র : পিউ ফোরাম অন রিলিজিয়ন এন্ড পাবলিক লাইফ, ওয়াশিংটন)। এখন এদের মধ্যে ৩৫ ভাগই যদি জঙ্গী মনোভাবাপন্ন হন তাহলে দুর্ভাবনা কার না হবে? ৩৫ ভাগ মুসলমান জঙ্গী মনোভাবাপন্ন হলে তার অর্থ দাড়ায় কানাডার জনগন প্রায় ৩ লাখ ৩৩ হাজার জঙ্গী সমর্থক নিয়ে বসবাস করছেন! এর মধ্যে প্রকৃত জঙ্গীর সংখ্যা কতজন কে জানে। উল্ল্লেখ্য যে, কানাডার মোট জনসংখ্যার শতকরা ২.৮ ভাগই মুসলমান।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার গত বছর ৮ সেপ্টেম্বর এখানকার জাতীয় টিভি নেটওয়ার্ক সিবিসি’র সাথে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন, ৯/১১ এর এক দশক পর এখনো কানাডায় সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা হুমকী ইসলামী জঙ্গীবাদ। তবে তিনি এও স্বীকার করেন যে, আগের তুলনায় নিরাপত্তা ঝুকি এখন কম। সিবিসি’র চীফ করসপন্ডেন্ট পিটার ম্যানসব্রিজের নেয়া ঐ সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার আরো বলেন, কিন্তু ঝুকি কম হলেও প্রধান হুমকী এখনো ঐ ইসলামী জঙ্গীবাদই।
আমরা জানি ২০০৬ সালে কানাডার অন্টারিওতে ১৮ জন মুসলমান যুবককে আটক করা হয়েছিল জঙ্গী হামলা চালানোর পরিকল্পনা করার জন্য। তাদের মধ্যে কয়েকজনের সাজাও হয়েছে বিভিন্ন
মেয়াদে। পরবর্তীতে কানাডার রাজধানী অটোয়াসহ অন্যান্য এলাকা থেকে আরো ৪ জনকে আটক করা হয়েছিল বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে। এর পর থেকেই মূলত উদ্বেগ শুরু হয় কানাডার অভ্যন্তরে জঙ্গী তৎপরতা নিয়ে।
সর্বশেষ আমরা দেখলাম টরোন্টো ও নিউ ইয়র্কের মধ্যে একটি ভিআইএ রেইল ট্রেন লাইনচ্যুত করার পরিকল্পার অভিযোগে টরন্টোর রায়েদ জাসের ও মন্ট্রিয়েলের শিহাব ইসেগায়ের নামের দুই যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে।
উপরে আমরা দেখলাম জঙ্গীবাদীদের আচরণ ও কর্মকান্ডের জন্য কানাডায় সাধারণ মুসলমানদের ভবমূর্তি আজ চরম সংকটের মুখোমুখি। এই জঙ্গীবাদীদের কারণে কানাডায় তৈরী হয়েছে ইসলামোফোবিয়া। কানাডার মুসলমান জনগোষ্ঠির জন্য এটি মোটেও সুখবর নয়। কানাডা আমাদেরও দেশ। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে আমরা কানাডার সব নাগরিকের নিরাপত্তা চাই। কানাডায় আমাদের পরবর্তী প্রজন্মরা যাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারে সে ব্যাপারে আমাদেরও কিছু করনীয় রয়েছে।
প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে আজকে আমন্ত্রিত অতিথিদের কাছে আহ্বান রইল- কানাডায় মুসলমানরা কিভাবে জঙ্গীবাদকে প্রতিহত করতে পারেন এবং এখানকার মুসলমানরা কিভাবে ভাবমূর্তি সংকট থেকে রেহাই পেতে পারেন এবং একই সাথে মূলধারার জনগোষ্ঠির মন থেকে ইসলামোফোবিয়াকে কিভাবে দূর করা যায় সে বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য।
আজকের গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালক হিসেবে রয়েছেন আনোয়ার কবীর।
আনোায়ার কবীর:
প্রথমেই আমি আহ্বান করবো জনাব ফয়জুল হককে তার মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরার জন্য।
ফয়জুল হক
টেরোরিজম বা ডমেষ্টিক টেরোরিজম একটি বিশদ ব্যাপার, সমস্যাটি রাজনৈতিক । আজকের বৈঠকের শুরুতে সম্পাদক খুরশিদ আলমের স্বাগত বক্তব্যে অল ওভার দি ওর্য়াল্ড অর্থাৎ আলজেরিয়া, স্পেন, লন্ডন, মাদ্রিদ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া জঙ্গীবাদী ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ননা উঠে এসেছে। ইংল্যান্ডের একটি ম্যাগাজিন- ব্রিটিশ জার্নাল অব পলিটিক্স অ্যান্ড ইন্টারনেশনেল রিলেশন এর ডেফিনিশন অনুযায়ী উড়সবংঃরপ ঞবৎৎড়ৎরংস রং ধ ৎবংঁষঃ ড়ভ ষধপশ ড়ভ ড়ঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃরবং ভড়ৎ সবধহরহমভঁষ ঢ়ড়ষরঃরপধষ বহমধমবসবহঃ. এর সাথে আমি একমত। এখানে বলা হয়েছে ডমেষ্টিক টেরোরিজম এর মূল কারন হচ্ছে (১) খধপশ ড়ভ ড়ঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃরবং ভড়ৎ গরহড়ৎরঃু ঢ়বড়ঢ়ষব (২) ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হধষ পযধহমবং রহ ঃযব বষবপঃরড়হ ংুংঃবস। এই ২টি পরিস্থিতি তৈরি করছে সরকার। সমাধানের দায়িত্বও সরকারের। আমরা যদি ক্যানাডার দিকে শূধূ তাকাই -১৯৭১ এ প্রথম মাল্টিকালচারালিজম শুরু হয় কানাডায়। কিন্তু প্রকৃত মাল্টিকালচারালিজম কানাডিনরা দেখছে না-ঐযে ব্রিটিশ ম্যাগাজিন যা বলছে সে অনুযায়ী এটা এখন কনফ্লিক্টের জন্ম দিয়েছে , এটি রাজনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন জাতি গোষ্টীকে মাল্টিকালচারালিজমর নামে এক একটি কূপের ভেতর রেখে দেওয়া হয়েছে । নতুন প্রজন্মকেও মাইনোরিটি ইমিগ্রান্ট হিসাবে রেখে দেওয়া হচ্ছে । এর থেকে সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন সমস্যার। ডমেষ্টিক টেরোরিজম এর একটি। খধপশ ড়ভ ঙঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃরবং ওদেরকে ধর্মীয় ইমোশন থেকে ধীরে ধীরে এক্সট্রিমিষ্ট করে তুলছে । সুযোগ নিচ্ছে বিভিন্ন টেরোরিস্ট অর্গেনাইজেশন। ধর্মীয় ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে অদের উপর রহভষঁবহপবফ সৃষ্টি করে টেরোরিষ্ট বানিয়ে নিচ্ছে । চিন্তাটিকে আমাদের কমিউনিটিতে নিয়ে আসেন। আমি আপনি টেরোরিস্ট না, তাহলে কারা টেরোরিস্ট ?- আমাদের বাচ্চারা? স্কুলে রেসিজমের জন্য আপনার বাচ্চা একই গায়ের রংয়ের বাচ্চার সাথে মিশছে, সাদা চামড়ার বাচ্চার সঙ্গে মিশতে পারছে না। ভাষা ও জাতীয়তা থাকা সত্বেও পারছে না কয়েকটি কারণে: মা-বাবা চাচ্ছে না তার বাচ্চা সাদাদের সঙ্গে মিশুক। আবার ও যখন সাদার কাছে যাচ্ছে সাদারা ভাবছে ও আমাদের মত না। এ থেকেই কনফ্লিক্টের সৃষ্টি। সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেনীর ঊগ্রবাদী , কচি মনের বাচ্চাদেরকে মগজ ধোলাই করে ঠেলে দিচ্ছে টেরোরিজমে । অন্যদিকে এদেশে জন্ম নিয়েও শুধূ মাত্র মাইনোরিটি (গাএর রঙ) হওয়ার কারনে চাকুরী ক্ষেত্রের ভালো সুযোগ থেকে ওরা হচ্ছে বঞ্চিত। মানসিক চাপ ওদেরকে ঠেলে দিচ্ছে খারাপ পথে। সুতরাং সরকারের পলিসি ই হচ্ছে ডমেস্টিক টেরোরিজম অরিজিনেশন এর মূল কারন। ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে এবং আমিও এর সাথে একমত।
সাইফুল কবীর ভূঁইয়া
ব্যাপারটি সম্বন্ধে আমি হয়তো বেশি জানিনা, তবে এটুকু বলি, ইসলাম একটি সুন্দর ধর্ম, মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু এটাকে আসলে ব্যবহার করে কেউ কেউ অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গীবাদ/ মৌলবাদ যাই বলেন এটা আসলে ইসলাম ও আমাদের হেয় করছে। এখন এর বিরুদ্ধে কি করার আছে? আসলে আমি মনে করি, বার্থ টু ডেথ এভরি মোমেন্ট ইসলাম আমাদের কল্যাণের জন্য। এখন ইসলামকে আপনি আপনার স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেন সেটা ইসলামের দোষ না। আমরা মুসলমানরা ইসলাম সম্বন্ধে জানি কম, ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছি। সেজন্যই আমাদের এই সমস্যা। তাই আমি মনে করি মানুষ যদি নিজেকে ইসলামের নিয়মে নিজেকে পরিচালনা করে অ্যাট লীস্ট তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। ইসলাম শান্তির ধর্ম। জঙ্গীবাদ বলেন সন্ত্রাসবাদ বলেন; এসব ইস্যু বানিয়ে ধর্মকে ইউটিলাইজ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকা উচিৎ।
জাহাঙ্গীর আলম
যে বিষয় নিয়ে আজকের গোলটেবিল বৈঠক, এটি একটি মেজর ইস্যু। আমরা এই প্রবাসে আছি, ওপর থেকে মনে হয় সবই খুব সুন্দর। আসলে তা নয়। জঙ্গীবাদের যে প্রশ্নটি আসছে আমি মনে করি, ইট ইজ অ্যা সেটআপ, মেজর সেটআপ ইন্টারন্যাশনালি টু মেক মানি। ইটস নট অ্যা রিলিজিয়াস ইস্যু অর এনিথিং এলস। ইটস অল সেট আপ টু মেক মানি। তাছাড়া মোস্ট অব ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া ইজ ওনড বাই দেম। আমাদের মনে রাখতে হবে- এদেশেই আমাদের থাকতে হবে। এখানে আমাদের জেনারেশন সেট হয়ে গেছে। যতই বলি আমরা অ্যাকচুয়ালি বাঙ্গালী না। আমরা সবাই ভুলে যাই যে এই সমাজ থেকেই আমাদের কিছু শিখতে হবে। কিন্তু সবাই নিজের চিন্তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করি। তখনই কনফ্লিকটের শুরু। আমরা ব্যস্ত থাকায় বাচ্চাদের সময় দিতে পারি না। যদি তাদেরকে স্পোর্টসে ইনভলভড্ রাখা যায় তাহলে আমার মনে হয় জঙ্গীবাদ থেকে বাঁচার সম্ভাবনা আছে।
আর ধর্ম কখনোই জঙ্গীবাদ শেখায় না। আমার ইসলামের জ্ঞান না থাকলেও যতটুকু ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি-পড়াশোনা করেছি দেখেছি যে ইসলাম কখনোই জঙ্গীবাদ শেখায় না। এই অবস্থা থেকে বের হতে আমাদের সচেতন হতে হবে। বাচ্চাদের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। আর লোকাল পলিটিক্স ছেড়ে কানাডীয় পলিটিক্সে ইনভলভড্ হতে হবে।
জহিরুল ইসলাম
জঙ্গীবাদ ওয়ার্ল্ডওয়াইড একটি পেটেন্ট হয়ে গেছে। মুসলমান হলেই মনে করে জঙ্গী। আমরা সবাই; সাধারণ মুসলমানরা এর ভিক্টিম। জঙ্গীবাদের লেবেলের জন্য মুসলমানরা কর্মক্ষেত্রে ভূগছে। এখন এটি মিডিয়ার সৃষ্টি হোক বা যাই হোক; অনেকেই বলছেন আমাদের ছেলেরা মসজিদ মাদ্রাসায় গিয়ে এ ব্যাপারে অ্যাট্রাক্টেড হয়ে যাচ্ছে। কিছু গ্রুপ এসব করছে। গভারমেন্টের উচিৎ ওই গ্রুপগুলোকে কন্ট্রোল করা। সেই ৭০ দশকের শেষ ও ৮০ র শুরুতে আমি লন্ডনে পড়াশোনা করেছি। আমি দেখেছি সেখানে কেউ কেউ এসব করছে। এখানেও তাদের কর্মকান্ড রয়েছে। সরকারের এ ব্যাপারে আরো কড়াকড়ি আরোপ করা উচিৎ। প্রয়োজনে জঙ্গীবাদের ট্রেনিং হচ্ছে সন্দেহ হলে সেসব জায়গায় মনিটরিং করতে হবে।
সাইফুল হক খান
২৩ বছরে কানাডায় অনেক কিছুই দেখেছি। কোন প্রকৃত মুসলমান টেরোরিজমকে সাপোর্ট করে না, আসলে কোন ধর্মই টেরোরিজমকে সাপোর্ট করে না। আজকের ঘটনা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দিকে সরে গেছে। আমাদের সন্তানরা টেরোরিজমের দিকে ধাবিত হচ্ছে একটাই কারণে- আমরা দেশ থেকে যে ধারণা নিয়ে আসছি কানাডায় সেটিই এসটাবলিস্ড করার চেষ্টা করি। সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এগ্রেসিভ মাইন্ডকে টেরোরিজমে ডাইভার্ট করে যদিও টেরোরিজম তার ইনটেনশন না। আরেকটি কারণ হলো আমরা অনেক বেশি মিডিয়া নির্ভর। সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে।
মঞ্জুর কাদির
আমাদের আজকের আলোচন্য বিষয় মুসলমানদের ভাবমূর্তী। বিশেষ করে কানাডার মূলধারাকে কিভাবে ইসলামভীতি থেকে রক্ষা করা যায়।
আমি এখানে আসার আগে প্রায় ২০ বছর আমেরিকাতে ছিলাম। সেখানে আমি আইটি সেক্টরে কাজ করেছি। আমেরিকায় যখন আমার ইমিগ্রেশনের কাজ হচ্ছিল ঠিক সেই সময় সেপ্টেম্বর ইলেভেনের ঘটনা ঘটে। আমরা জানি মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীরা ওই হামলা চালায়, এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। এরপর থেকে মুসলমানরা সারা বিশ্বেই জঙ্গী হিসেবে ট্রেডমার্ক হয়ে গেছে। ওই ঘটনায় আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে আক্রান্ত হই। ওই সময় আমার ইমিগ্রেশনের প্রক্রিয়া চলছিল। আমার আইনজীবী আমাকে জানালো, যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে আমেরিকায় হয়তো তোমার ইমিগ্রেশন হবে না। তারচেয়ে বরং তুমি কানাডায় চেষ্টা কর। আমার আইনজীবী আমাকে সব কাগজপত্র ঠিকঠাক করে দেয়। কানাডায় আসার সময় একটা চাকরির নিয়োগপত্র আমার হাতে ছিল। কিন্তু ওই সময় ২০০২ সালে আইটি সেক্টরের বাজার খারাপ যাচ্ছিল বলে শেষ পর্যন্ত ওই চাকরিটা আমার হয়নি। এরপর আমি আরো কয়েক জায়গায় চাকরির চেষ্টা করলাম। একজন রিক্রুটার আমাকে পরামর্শ দিলো আমার ইসলামিক নাম পরিবর্তন করার। তিনি খান বানানটা শযধহ না লিখে শধযহ লেখার পরামর্শ দিলেন। শধযহ খুবই প্রচলিত একটি ইহুদী নাম। তো আমি তার কাছে জানতে চাইলাম আমি কেন এটা করবো? তিনি বললেন, তোমার যেহেতু মুসলিম নাম। এই নাম নিয়ে চাকরির সুযোগ পাওয়ার তেমন কোন আশা দেখছি না। তারচেয়ে নাম যদি পরিবর্তন করো তাহলে আমি তোমাকে কয়েক জায়গায় পাঠাতে পারি। আমি তার প্রস্তাবে রাজি হলাম। এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো পরের সপ্তাহে আমার তিনটি ইন্টারিভিউয়ের ডাক এলো। এই গল্প বলার উদ্দেশ্য হলো এই আমি ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি মুসলিম সন্ত্রাসবাদের শিকার। আমার জানামতে ইসলাম সরাসরি জিহাদকে সমর্থন করে। যারা বলছেন ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ মিডিয়ার তৈরি-তাদের বক্তব্য মোটেও ঠিক নয়।
মনির ইসলাম
আমি নিজেও জঙ্গীবাদের একজন ভুক্তভোগী। আমরা যেহেতু মুসলমান সেই হিসেবে আমরাই সবচেয়ে বেশি ভিকটিম এতে কোন সন্দেহ নাই। তবে জঙ্গীবাদ সমস্যা শুধু যে ইসলাম ধর্মেই আছে তা নয়। অন্যধর্মেও আছে। কিন্তু ইসলামে একটু বেশি এটা স্বীকার করতেই হবে। তবে জঙ্গীবাদের কারণ কি সেটাও আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। আমার মতে এটা স্রেফ মগজ ধোলাই। কিছু লোক নিজের বা ধর্মীয় যে স্বার্থেই হোক না কেন ধর্মকে বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে উগ্রবাদ বা জঙ্গীবাদের জন্ম দিচ্ছে। এখন আমাদের ভাবতে হবে এই সমস্যার থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি? আমার মতে সমস্যার সঠিক সমাধান ইসলামিক রীতি নীতি সম্পর্কে যারা সম্যক অবগত বা আলেম তারাই দিতে পারবেন। আলেমদের নিয়ে আলোচনা সভা করা যেতে পারে। জঙ্গীরা কিভাবে ধর্মের ভুল ব্যাখা দিয়ে মানুষকে সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সে বিষয়টা যদি সবাইকে ভালভাবে বোঝানো যায় তাহলে হয়তো সমস্যার সমাধান হতে পারে।
নূর মোহাম্মদ
সেপ্টেম্বর ইলেভেনের পর পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে আমেরিকায় মুসলমানরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছে। আবার কোন রকম ঝামেলায় পড়েনি এমন লোকও আছে। আমেরিকায় যাওয়ার সময় অনেককে নানা ধরণের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়। আবার ভেতরে নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কাউকে কাউকে। তবে এটা শুধুমাত্র মুসলমানদের সাথে হচ্ছে নাকি অন্য দেশের মানুষের সাথেও এমনটা করা হয় সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। আমার মতে ইসলামিক জঙ্গীবাদ প্রসারের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তারমধ্যে একটা কারণ হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোর সরকার প্রধানদের গাফলতি। আমাদের মুসলিম নেতাদেরও এটা নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই বা এ বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে তাদেরকে তেমন কোন বড় ভূমিকা রাখতে
দেখা যায় না। ইসলাম ধর্মকে বিভিন্ন মানুষ নিজের স্বার্থে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছে। আর ইসলামভীতি ছড়ানোর ক্ষেত্রে মিডিয়ারও একটা ভূমিকা আছে বলে আমার মনে হয়। সিএনএন বা বিবিসি’র মতো গণমাধ্যম যেহেতু পশ্চিমা দেশ এবং তাদের সংস্কৃতিকে ধারণ করে, তাই ওরা যেটা বলে ওইসব দেশের মানুষ দেখা যায় সেটাই বিশ্বাস করে।
খাজা চিশতী
আমরা এখানে সন্ত্রাসবাদ বা উগ্রবাদের শিকার। ইসলাম অবশ্যই শান্তির ধর্ম। ইসলাম কখনই সন্ত্রাসবাদ সমর্থন করে না। যারা উগ্রবাদী তাদের কথা আলাদা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তরুণ বা দ্বিতীয় প্রজন্ম সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে জড়িত হচ্ছে। এরা সাধারণত ফেসবুক বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এখন আমাদের করণীয় হচ্ছে ইসলাম ধর্মটাকে যেন কেউ জঙ্গীবাদ হিসেবে প্রচার না করতে পারে এবং আমাদের সন্তানরা যাতে এর সাথে কোনভাবেই জড়িত না হয় সেই চেষ্টা করা। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে বাচ্চারা কার সাথে মেলামেশা করছে। তাদের বন্ধু কারা। ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে তাদের কার সাথে যোগাযোগ হচ্ছে এটা একটু দেখা। দুই নম্বর হলো তাবলিক জামাত-এরা ভাল আমি স্বীকার করছি। এরা ইসলাম প্রচার করে। তবে অনেক সময় এখান থেকে জঙ্গীবাদের জন্ম হয় বলে আমার ধারণা। আমাদের করণীয় হবে তবলিক জামাতকে যেন শুধুমাত্র ইসলাম ধর্ম প্রচারের কাজে ব্যবহার করা হয়, জঙ্গীবাদ সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে একে যেন ব্যবহার করা না হয়।
মিজানুর রহমান
ধর্মীয় উন্মাদনা বলতে আমি যা বুঝি সেটা শুধু ইসলাম ধর্মে কেন আমি সব ধর্মেই সেটা দেখছি। সেটা আমি হিন্দু ধর্মে দেখছি, সেটা আমি খ্রীস্টান ধর্মে দেখছি। প্রচারণাটা হয় বেশি ইসলাম ধর্মকে নিয়ে। আরেকটা কথা এসেছ এর সমাধানের পথ কি হতে পারে? কানাডায় আমাদের যারা দ্বিতীয় প্রজন্ম যাদের কথা আমার আগের বক্তারা উল্লেখ করেছন, স্বাভাবিকভাবে আমার ছেলেও এখানে জন্ম নিয়ে এখন মাশাল্লাহ ১২-১৩ বছর বয়স। এখন সে অনেক কিছুই বোঝে। তাদের একটা ইউনিটি আছে ফেসবুক বলেন বা টুইটার বলেন-এভাবে তারা এগুলো শেয়ার করে। সে তারাবারি নামাজেও যায় সে রোজাও রাখছে, তার কাছেও মাঝে মাঝে এগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়। হয়তো সে তবলিগের সাথে পড়ছে। আমি সব সময় সাথে থাকছি না দেখছি না সে কোথায় যাচ্ছে। সে আরবীও পড়তে যায়, সেখানে পাকিস্তানী হুজুর তাকে কি বলছে না বলছে এগুলো সে এসে আমার কাছে আলাপ করে। কিন্তু আমি কন্ট্রোল করি। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যারা আমাদের সবার সন্তান এখানে বড় হচ্ছে আমাদের এগুলো লক্ষ্য রাখতে হবে তারা যেন অতিমাত্রায় ধর্মান্ধ না হয়ে যায়। সে অবশ্যই ধর্মভীরু হবে। কুরআন সুন্নাহর বাইরে বিষয়ে সে যেন জড়িত না হয়ে পড়ে। অতিমাত্রায় সে যেন উন্মাদ হয়ে না যায়। আমার কথা হলো আমাদের ধর্মীয় যে রীতি নীতি আছে আমরা সেগুলো পালন করবো।এটা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা দিতে হবে, ধর্মের বার্তাটা তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। আমরা যেমন বড় হয়েছি আমরা অতি উন্মত্ততার মধ্যে ছিলাম না। আমাদের ধর্মেও বলা আছে যে নামাজ আদায় করার সাথে সাথে তোমার রুজি রোজগারের জন্য বেরিয়ে পড়। আমাকে ওটাও মাথায় রাখতে হবে আমাকে চাঁদা তুলে যেন রোজগার করতে না হয়, আমাদের দিন যাপন করতে না হয়। আবার ইসলাম আমাদের ধর্ম, আমরা মুসলিম, কিন্তু তাই বলে আমাদের জীবনটাকে যেন কট্টর নীতির মধ্যে নিয়ে না যাই। এই জিনিসগুলো থেকে যদি আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারি তাহলে হয়তো সমস্যার সমাধান করেত পারবো।
আনোয়ার কবির আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভায় আমরা কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মূল্যবান বক্তব্য শুনলাম। আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেও দেখেছি ৯/১১ এর পর প্রবাসে মুসলমানরা নানা সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন। আমি দেখেছি, আমার এক বন্ধুর ভাগ্নে ইংল্যান্ড থেকে পিএইচডি করে এসে এখানে অড জব করছিল। সৌভাগ্যক্রমে ইমিগ্রেশন হয়ে যাওয়ার পর একটা ভাল চাকরি পেয়ে যায়। উনি একজন সাইন্টিস্ট হাসপাতালের। একবার আমেরিকায় এক কনভেনশনে যেতে গিয়েও উনি যেতে পারলেন না। কারণ ইমিগ্রেশন পেলেও কানাডিয়ান নাগরিক হয়নি তখনো এবং তার নাম হলো ইসলাম। পার্মানেন্ট রেসিডেন্টদেরকে আমেরিকার ভিসা পেতে হলে দীর্ঘ প্রক্রিয়া মাধ্যমে যেতে হয়। পরবর্তীতে অবশ্য উনাকে ১৫ মাসের ভিসা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর কনভেনশনে যোগ দেননি, কারণ কনভেনশন তার আগেই শেষ হয়ে গেছে। আমার এক বন্ধূর ছেলে থাকে পাশের শহর হ্যামিলটনে।ওখানে একজন ডাক্তার মানুষ। উনি কোরআন শরীফ পড়ান বাসাতে এবং আমার ওই বন্ধূর ছেলে তার প্রথম ছাত্র। পরে সে স্কুলে যায়, বেশ ভাল, বেশ ভাল কথাবার্তা বলে, খুব কম বয়স মাত্র ১৫। দুর্ভাাগ্যক্রমে সে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যায়। কে তাকে অনুপ্রাণীত করছে, কে তাকে নিয়ে যাচ্ছে? মিজান ভাই একটু যা বললেন-আমরা কিন্তু বাংলাদেশীরা এই এক্টিভিটিসের সাথে জড়িত না। কোন না ভাবে আমরা নিজেদেরকে সরিয়ে রাখি। কিন্তু আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মটা কিন্তু নিরাপদ না। এটাকে নিয়েই বিজনেস হচ্ছে। এই ছেলেদেরকে করাপ্টেড করা, মাদক ব্যবসায় জড়ানো। আমার ছেলেটা ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে গ্র্যাজুয়েশন করেছে, এখন ল তে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আমার বন্ধুরা বলেন, কবির ভাই একটু খেয়াল রাখবেন। চাপ দাড়ি রাখে ও একটু অন্যদিকে চলে গেলো কিনা। মানে এটাও একটা আতংক। লাইনচ্যুত হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। এই যে লাইনচ্যুত হওয়া, এটা কি আমার নিজস্ব ইচ্ছা নাকি আমার সমাজ ব্যবস্থা। আমরা আসলে পরিস্কার বুঝে গেছি। ইসলাম ভীতিটা এমনভাবে কালারড করা হচ্ছে-যে যা কিছুই ঘটুক না কেন এদেরকে রহাড়ষাব করিয়ে দেয়া হোক। আমাদের সমাজটাকে আমাদের প্রজন্মকে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমার মনে আমাদের আরেকটু ফ্রেন্ডলি হওয়া উচিৎ আমাদের সন্তানদের সাথে। আমাদের ভেতরেও ফ্রেন্ডশিপ বাড়ানো উচিৎ। কমিউনিটিতে জঙ্গীবাদ বিরোধী সচেতনতা বাড়ানোর যে কাজটা প্রবাসী কন্ঠের সম্পাদক করছেন পত্রিকার মাধ্যম দিয়ে,এটা যদি হতে থাকে হরহামেশা তাহলে সবার সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধুত্ব বাড়বে এবং সেইসাথে আমরা অবহিত হবো কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে। এবং ফিরে গিয়ে হয়েতো বসার চেষ্টা করবো ছেলে-মেয়ের সাথে। তাদেরকে গাইড করার চেষ্টা করবো। যেটা হয়তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম একসময়। এবং আমি বলবো প্রজন্মকে নিয়েও যদি কিছু করা যায় তাহলে আরো ভাল হবে।