প্রবাসে দেশী শাক-সবজী আবাদের টুকিটাকি

ড.জহিরুল ইসলাম : প্রবাসে বসে দেশী শাকের কথা ভাবতে গেলে প্রথমে যে শাকটির কথা প্রায় সবার মনে পড়বে সেটি হল লালশাক। তারপর ডাঁটাশাক, মুলা শাক, পুইশাক, কলমিশাক বা কেংকং, লাউশাক, কুমড়া শাক ইত্যাদি। এরমধ্যে লালশাক, ডাঁটাশাক, মুলাশাক, পুইশাক, কলমিশাক বা কেংকং আবাদ করে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই খাওয়া যায়। রোদযুক্ত এক চিলতে জমি অথবা ট্রেতে এই সকল শাকগুলি আবাদ করা যায়। আর লাউ ও কুমড়া গাছ লাগালে উপরি হিসাবে শাক খাওয়া যাবে। তবে এই গাছগুলি লতানো ও লম্বা হয় বলে বেশী জায়গার প্রয়োজন, এবং মাচা করে দিতে পারলে ভাল হয়।

জমি প্রস্তুত:

শাক আবাদের জমিটুকু ভাল করে পরিষ্কার করে নিতে হবে, বিশেষ করে কোন আগাছা যেন না থকে। কিছু গোবর সার বা কম্পোষ্ট ছিটিয়ে মাটি সাভোল বা কোদাল দিয়ে প্রায় চার-পাঁচ ইঞ্চি গভীর করে উল্টিয়ে দিতে হবে। সমস্ত ঢিলা ভেঙ্গে, আর একবার গোবর সার বা কম্পোষ্ট ছিটিয়ে দিয়ে সাভোল বা কোদালের সাহায্যে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। কি পরিমাণ গোবর সার বা কম্পোষ্ট প্রয়োগ করতে হবে তা নির্ভর করবে আপনার বাগানের মাটির অবস্থার উপর। তবে সাধারণ ভাবে বলা যায় প্রতি চার বর্গ মিটার জায়গায় মোট এক ব্যাগ গোবর সার বা কম্পোষ্ট প্রয়োগ করতে পারেন, বেশী গোবর সার বা কম্পোষ্ট দিলে ভাল বই খতি হবে না।

শাক আবাদের জন্য যদি কোন প্লট বা জমি না থাকে, অথবা আপনি যদি এপার্টমেন্টবাসী হন তবে বারান্দা সহ রোদযুক্ত কোন স্থানে ট্রেতে লালশাক, মুলাশাক, ডাঁটাশাক, কলমিশাক বা কেংকং, ও পুইশাকের আবাদ করতে পারেন। তবে প্রথমেই ট্রে-এর তলদেশে কয়েকটি ছিদ্র করতে ভুলবেন না। ট্রে-এর ভীতর অন্তত ১০ সে: মিঃ গভীর মাটি থাকতে হবে; টপ সয়েল ও গোবর সার বা কম্পোষ্ট আধাআধি মিসিয়ে ট্রেতে ভরতে হবে।

লালশাক, মূলাশাক, ও ডাঁটাশাক এবং ধনে পাতা:

লালশাক, মূলাশাক ও ডাঁটাশাক এবং ধনে পাতা অতি উপাদেয় ও সুস্বাদু এবং খাদ্যপ্রাণে সমৃদ্ধ যা সহজেই আবাদ করে স্বল্প সময়েই খাওয়া যায়। এ শাকগুলোর বীজ বুনতে হবে। আপনার নিকট যদি বীজ না থাকে তবে বন্ধু বান্ধবদের নিকট খোজ নিয়ে দেখতে পারেন। বাংলাদেশী গ্রোসারিতেও হয়ত বীজ পেতে পারেন। টরেন্টো শহরের ডেনফোর্থ এলাকায় সরকার ফুডসে বাংলাদেশী সবজীর বীজ আমি দেখেছি, হয়ত অন্যান্য গ্রোসারী গুলোতেও আছে। তবে লালশাক ও ডাঁটাশাক একবার যদি আবাদ করতে পারেন তবে জমির কোনে দুইটি গাছ রেখে দিয়ে যতœ নিতে হবে। ঐ গাছে ফুল হয়ে বীজ হবে। বীজ পাকলে ডালাগুলি কেটে ট্রে বা বাটিতে নিয়ে শুকিয়ে বীজ আলাদা করে নিবেন। বীজ ভাল ভাবে শুকিয়ে পরিষ্কার করে শুকনা পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। এতে একবার বীজ পেলেই আপনাকে আর বীজ খুঁজতে হবে না।

ধনের বীজ গজাতে বেশ কয়েক দিন লাগে তাই ঘরে একদিন ভিজিয়ে রাখলে ভল হয়। লালশাক ও ডাঁটাশাকের বীজ খুবই ক্ষুদ্র বলে ছিটিয়ে বুনতে এক সঙ্গে অনেক গুলি বীজ পরে যায়। তাই কয়েক মুঠু শুকনা গুরা মাটি বা বালি নিয়ে তার সঙ্গে বীজ ভালভাবে মিসিয়ে দিতে হবে। তারপর বীজ মিশ্রিত বালি বা গুড়া মাটি জমিতে সমান ভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। সাভোল বা কোদাল দিয়ে হালকা ভাবে মাটি কুপিয়ে বীজ মাটির ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে। তারপর হাত আঁচড়া দিয়ে উপরের মাটি আড়াআড়ি ভাবে দুইবার আঁচড়িয়ে মাটি সমান করে দিতে হবে। হালকা ভাবে পানি দিয়ে পলিথিন জাতীয় কোন সিট দিয়ে এক বা দুই দিন ঢেকে রেখে পলিথিন সরিয়ে ফেলতে হবে। এতে বীজ দ্রুত গজাবে। নিয়মিত হাল্কা ভাবে পানি দিতে হবে। মূলা দ্রুত গজিয়ে যাবে এবং লালশাক, ডাটা ও ধনে গজাতে কয়েক দিন লাগতে পার।  নিয়মিত শাক পেতে হলে নির্ধারিত জমি বা জমির অংশটি দুই বা তিন ভাগে ভাগ করে দুই সপ্তাহ অন্তর অন্তর বীজ বুনে যতœ নিতে হবে। মৌসুমের প্রথম দিকে বুনা এ সমস্ত শাকের কয়েকটা গাছ জমির এক কোনে রেখে দিলে আপনি সহজেই বীজ পেতে পারেন।

পরিচর্যা ও শাক তোলা:

লালশাক, মূলাশাক, ডাঁটাশাক ও ধনের জমি  বা ট্রে আগাছা মুক্ত রাখতে হবে এবং প্রয়োজন মত পানি হালকা ভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। বীজ গজানের এক সপ্তাহ পর গাছ ঘন অবস্থায় থাকলে নিয়মিত বাছাই দিয়ে হলকা করে দিতে হবে। লালশাক ও ডাঁটাশাক এবং ধনে পাতার গাছ ঘন ঘন থাকলে দ্রুত শক্ত হয়ে যাবে। বীজ গজানোর ১০ দিন পর থেকেই ৩-৪ দিন পর পর বাছাই করে কিছু গাছ তুলে হাল্কা করতে হবে এবং বাছাইকৃত শাক রান্না করে খেতে পারেন। যখন শাক তুলবেন বা বাছাই করবেন তখন জমি বা ট্রে-এর এক স্থান থেকে না তুলে সমস্ত জমি বা ট্রে থেকে বাছাই করে বড় বড় গাছগুলি তুলতে হবে (ছবি দেখুন) । তাতে করে নীচের ছোট গাছ গুলো বড় হয়ে উঠবে। প্রতি  সপ্তাহে বা ১০ দিনে এক বার অল্প পরিমাণে দানাদার রাসায়নিক সার (৫-৬ বর্গ মিটারে এক টেবিল চামচ) ছিটিয়ে দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিবেন বা মিরকেল গ্রো এক চামচ (সঙ্গে যে চামচ থাকে সে চামচে) প্রতি আট লিটার পিনিতে মিসিয়ে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। রাসায়নিক সার বেশী পরিমাণে দিবেন না, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কি সার দিতে পারেন সে সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হয়েছে।

কলমিশাক ও পুইশাক

উপরের বর্ণনা অনুযায়ী জমি বা ট্রে প্রস্তুত করতে হবে। প্রায় ১৫ ইঞ্চি দুরে দুরে সারিতে বীজ বুনতে বা চারা লাগাতে হবে। প্রয় ২ ইঞ্চি গভীর করে লাইন করে প্রতি লাইনে দুই ইঞ্চি পর পর দুটি করে কলমির বীজ ফেলতে হবে এবং পুইশাকের বেলায় ছয় ইঞ্চি পর পর দুটি বীজ ফেলতে হবে। তারপর গুড়া মাটি দিয়ে লাইন ডেকে দিতে হবে, হালকা ভাবে পানি দিয়ে পলিথিন সিট দিয়ে এক বা দুই দিন ঢেকে রাখতে পারেন। পলিথিন উঠানোর পর নিয়মিত হালকা ভাবে পানি দিতে হবে। ছয় ইঞ্চি পর পর পুইশাকের চারাও লাগাতে পারেন। গাছ গজানোর বা চারা লাগানোর প্রায় এক সপ্তাই পরে সামান্য পরিমাণে দানাদার সার (গাছ প্রতি

দুই আঙুলের এক চিমটি) দুই সারির মাঝে প্রয়োগ করে  ট্রাওয়ালের সাহায্যে মাঝের মাটি ২ ইঞ্চি ডীপ করে গাছের সারিতে তুলে দিতে হবে। এতে যে নালাটির সৃষ্টি হবে তাতে পানি দিতে হবে। প্রতি ১০ দিন অন্তর অন্তর সার দিতে হবে এবং গাছের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। দুই বা তিন দফা নালার মাটি তুললেই চলবে, তারপর গাছের লাইনের দুই পাশে উঁচু সারিতে সার ছিটেয় দিয়ে গার্ডেন ফর্ক দিয় হালকা ভাবে মাটির সঙ্গে মিসিয়ে দিতে হবে। পুইশাকের গাছ ১০-১২ ইঞ্চি উঁচু হলে গোঁড়া থেকে ৩ ইঞ্চি উপরে কেটে নিতে হবে। গাছর গোড়ায় নতুন গাছ হবে, নতুন গাছেরও পরিচর্যা করতে হবে। আর কলমিশাকের মোটা ডাটা গুলো মাটি থেকে দুই ইঞ্চি উপরে কেটে নিতে হবে, তাতে করে চিকন গাছগুলি মোটা হবে এবং কাটা ডাটির গোঁড়া থেকেও নতুন শাখা হবে। নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। টবের পুইশাক গাছ শীতের আগে ঘরের ভিতরে রোদযুক্ত জানালার পাশে রেখে যতœ নিলে ডিসেম্বর-জানুয়ারীতে বীজ হবে। পাকা বীজ শুকিয়ে আগামী মৌসুমে বুনার জন্য সংরক্ষন করতে পারেন।

কি সার দেবেন?

জমি তৈরির সময় জৈব সার যথা গোবর সার বা কম্পোস্ট দেয়া হয়েছে। তবুও গাছের ভাল বৃদ্ধি ও ফলনের জন্য রাসায়নিক সার দেয়া প্রয়োজন।  মিরাকল-গ্রো ২০-২০-২০-বা ২৪-৮-১৬ নামের সারটি দিতে পারেন তবে খরচ একটু বেশী পরবে। মিরাকল-গ্রো ২০-২০-২০-বা ২৪-৮-১৬ ব্যাবহার করলে সারের সঙ্গে যে চামচ থাকে সেই চামচে এক চামচ প্রতি আট লিটার পানিতে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। আমি লন ফার্টিলাইজার বা হোম গার্ডেন অল পারপাস ফার্টিলাইজার ব্যাবহার করি, যা ৮-১০ কেজির পলি বেগে পাওয়া যায়। এন-পি-কে (ঘ-চ-ক) এর বিভিন্ন সংমিশ্রণে পাওয়া যায় যেমন ৭-৭-৭, ১০-১০-১০, ১০-১-৫, ২৬-০-৪। শাকে বেশী এন এবং কন্দল জাতীয় যেমন আলু, পেয়াজ, গাজর, বিট, ইত্যাদিতে বেশী  কে  প্রয়োজন হয়। শাক-সবজীর জন্য আলাদা আলাদা সার কিনার চেয়ে আমি সাধারণত অল পারপাস ফার্টিলাইজার ১০-১০-১০ বা ৭-৭-৭ ব্যাবহার করি। এক ব্যাগ কিনে সব শাক-সবজীতেই ব্যাবহার কবি। আপনার সারে যদি এন উঁচু মাত্রায় (১৬ বা অধিক) থাকে তবে সাবধানে তথা কম পরিমাণে ব্যবহার করবেন।

সংরক্ষণ:

অতিরিক্ত শাক-সবজী ব্লেন্চ করে ডীপ ফ্রিজে রাখতে পারেন। শাক ভালোভাবে ধুয়ে ও কেটে একটি তারের ছাকনীতে নিতে হবে। একটি হাড়িতে পানি ফুটাতে হবে। পানি ফুটতে থকলে ছাকনিটি হাড়ির মুখে বসিয়ে ডেকে দিতে হবে, যেভাবে ভাপা পিঠায় ভাপ দেয়া হয়। তিন মিনিটের মত ভাপ দিয়ে নামিয়ে নিন। শাক ঠাণ্ডা হলে এবং পানি ঝড়ে গেলে পলি ব্যাগে ভড়ে ডীপ ফ্রিজে রাখুন। তবে ধনে পাতা, মুলা শাক ও ডাঁটা শাক ব্লেন্চ না করেও ডীপ ফ্রিজে রাখা যায়।