কানাডায় মুসলিম কমিউনিটিতে বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি পাচ্ছে আশংকাজনকভাবে

প্রবাসী কন্ঠ প্রতিবেদন : একেক দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীতে বিবাহ বিচ্ছেদের হার একেক রকম। এ সম্পর্কে মনোভাবের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা দেখা যায়। আবার সভ্যতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে এ বিষয়ে মনোভাবেরও পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় ভিন্নতা থাকলেও প্রায় সব সমাজেই একে নেতিবাচক হিসেবেই দেখা হয় এখনো।

কোন কোন দেশে বা সমাজে বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের হার অতীতের তুলনায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে আশা জাগানিয়া কথা জানিয়েছে স্ট্যাটিসটিকস কানাডার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন। তারা বলছে, কানাডায় বিবাহ বিচ্ছেদের হার কমছে। “ডিভোর্স কেস ইন সিভিল কোর্ট” এই শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১০-২০১১ সাল পর্যন্ত সিভিল কোর্টে ৫৩,৮০৩টি বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা হয়েছে যা আগের বছরের তুলনায় ২ শতাংশ কম।

তবে এ থেকে ঢালাওভাবে এটা বলা যায় না, আগের যেকোন সময়ের তুলনায় বর্তমানে দাম্পত্য জীবন বেশি স্থায়ী হচ্ছে। কয়েক বছর আগে থেকে কানাডায় বিয়ের হার কমতে শুরু করে। ২০০৬ ছিল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সংখ্যা ছিল ১,৫০,৫০৫ যা ২০০৮ গিয়ে দাঁড়ায় ১,৪৭,২৮৮ এ।

কানাডায় পরিবারের কাঠামো দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। গত ২০ বছরে বিবাহিত দম্পতির সংখ্যা নিয়মিতভাবে কমেছে যেখানে কমন ল’ পার্টনারের সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপকহারে। ৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সিঙ্গল প্যারেন্ট পরিবারের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে নিয়মিতভাবে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিয়ের সংখ্যা ও হার কমলেও এখন পর্যন্ত কমন ল’ পার্টনারের তুলনায় বিবাহিত দম্পতির সংখ্যা বেশি।

বিবাহ বিচ্ছেদ বিশেষজ্ঞ এবং হাফিংটন পোস্টের ব্লগার ডেবোরাহ মোস্কোভিচ বলেন, “এখন অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ বিয়ে না করে একসাথে থাকা পছন্দ করছে। সম্ভবত এ কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের হার কমছে।” তিনি আরো বলেন, “তার মানে এই নয় যে, লোকজন সম্পর্ক তৈরি করা অপছন্দ করছে বা এড়িয়ে চলছে, বরং তারা সম্পর্কটাকে আনুষ্ঠানিক বা আইনগত ভিত্তি দিতে চাচ্ছে না।”

কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পর্কে কানাডার সামগ্রিক চিত্র আশাপ্রদ হলেও উদ্বেগের বিষয় হলো এখানকার মুসলিম কমিউনিটিতে বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। আর বাঙ্গালী মুসলিম পরিবারেও বিশেষ করে তরুন বা দ্বিতীয় প্রজন্মে এই বিবাহ বিচ্ছেদ আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত ‘হু কেয়ার্স’ মনোভাব থেকেই মনের মিল না ঘটলে বা অন্য কোন সমস্যা তৈরী হলে তরুন তরুনীরা বিবাহ বিচ্ছেদের মত কঠিন সিদ্ধান্তকে বেছে নিচ্ছে খুব সহজেই। এক্ষেত্রে অভিবাকদের কিছুই করার থাকছে না।

পরিবারে মুসলিম কালচারে বড় হলেও শিক্ষাজীবনে এবং কর্মক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙ্গালীরা বেশী সময় কাটাচ্ছে কানাডীয় কালচারে। দেখা গেছে দুই কালচারের মধ্যে কানাডীয় কালচারই বেশী প্রভাব বিস্তার করে তরুন তরুনীদের মধ্যে। কিন্তু বিয়ের পর পরিবার গঠনের সময় মুসলিম কালচারের চাপ থাকে বেশী। তখন দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে বাইরে কাজ করলেও রান্না-বান্না থেকে শুরু করে ঘরের অন্যান্য কাজ ও বাচ্চার দেখাশুনার বেশিরভাগ দায়িত্ব স্ত্রীকেই বহণ করতে হয়। পরিবারটি যদি হয় যৌথ অর্থাৎ ছেলের বাবা মা যদি একই পরিবারে থাকে তবে সেখানেও তৈরী হয় সমস্যা। কারণ অভিবাকরা পুত্রবধূর কানাডীয় ভাবসাব পছন্দ করেন না। অন্যদিকে পুত্রবধূ পছন্দ করেন না অভিবাবকদের সেকেলে ও রক্ষণশীল কালচার। ফলে তৈরী হতে থাকে বিরোধ।

অন্যদিকে ফেসবুকসহ নানান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সৃষ্টি হওয়াতে আবাধ মেলা-মেশার সুযোগ আগের তুলনায় বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এতেও তৈরী হচ্ছে নানান সমস্যা। একজনের প্রতি আরেকজনের সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে খুব সহজেই। সেই সঙ্গে নির্যাতনের বিষয়টিতো রয়েছেই। এই সমস্ত সংঘাত আর সন্দেহ তরুন প্রজন্মের বাঙ্গালী স্বামী-স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে ধাবিত করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাঙ্গালী অভিবাবক জানালেন, গত ৫ বছরে তিনি প্রায় ডজনখানেক বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। দুর্ভাগ্যের  বিষয় হলো, এদের বেশীরভাগ দম্পত্তিই এখন আলাদা হয়ে গেছে। কারণটা কি তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কানাডায় বড় হওয়া তরুন-তরুনীদের মধ্যে টলারেন্সি বা সহনশীলতা নেই। অল্পতেই তারা উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং ঘর ভাঙ্গার মত এমন বড়রকমের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে খুব সহজেই।

উত্তর আমেরিকান মুসলিমদের মধ্যে বিয়ে এবং বিবাহ বিচ্ছেদের প্রবণতা সম্পর্কে সম্প্রতি একটি গবেষণা চালিয়েছে ইন্সটিটিউট ফর সোসাল পলিসি অ্যান্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং-আইএসপিইউ। চার বছর ধরে এ বিষয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে সংস্থাটি। মুসলিম কমিউনিটি সদস্য, সোসাল ওয়ার্কার এবং আইনজীবীদের সাক্ষাৎকার গ্রহন করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ২৫ শতাংশ ছিলেন কানাডিয়ান। আমেরিকান ও কানাডিয়ান বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোন পার্থক্য নেই। সংস্থাটির পরিসংখ্যানে দেখা যায় নর্থ আমেরিকান মুসলিম কমিউনিটিতে বিবাহ বিচ্ছেদের হার গত ২৫ বছরে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

এছাড়া, ৯০ এর দশকের শুরুতে নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক প্রয়াত সমাজবিজ্ঞানী ইলিয়াস বা-ইউনুস পরিচালিত একটি গবেষনায়ও একই চিত্র উঠে এসেছিল। ইউনুসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নর্থ আমেরিকান মুসলিমদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার ৩১.১৪ শতাংশ। যা ছিল মুসলিম বিশ্বে ওই সময়ে সর্বোচ্চ বিবাহ বিচ্ছেদের তুলনায় তিনগুণ বেশি। (মিশর ও তুরস্কে এই হার ছিল ১০ শতাংশ)।

গত দুই দশকে নর্থ আমেরিকার পরিস্থিতির এর থেকে উন্নতি হয়নি। বরং ইমাম, কনসুলার এবং আইনজীবীরা বলছেন, তাদের কাছে বিয়ে সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে মুসলিম ক্লায়েন্টদের সাহায্য চাওয়ার হার যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা।

মুসলিম সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধির কারণ:

আইএসপিইউ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিবাহিত জীবনে সংঘাতের অন্যতম  প্রধান কারণ হচ্ছে সমাজ ও পরিবারে নারী-পুরষের ভূমিকার পরিবর্তন ও প্রত্যাশা। আগের তুলনায় অধিক সংখ্যক নারী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ এবং কর্মক্ষেত্রে যোগ দিচ্ছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাইরে কাজ করলেও ঘরের কাজ ও বাচ্চার দেখাশুনার বেশিরভাগ দায়িত্ব স্ত্রীকেই বহণ করতে হয়। ঘর এবং বাইরের কাজের মধ্যে যখন সামঞ্জস্যবিধানের প্রশ্ন আসে তখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দেখা দেয় সংঘাত। আর সংঘাত অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে ধাবিত করে।

আবার পরিবারের মূল কর্তৃত্বের বিষয়টিও অনেক সময় দাম্পত্য জীবনে ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে। বেশিরভাগ সময় পুরুষেরা ভাবে পরিবারের মূল কর্তৃত্ব থাকবে তাদের কাছে। তারা প্রায়ই মনে করে কারো সাথে কোন আলোচনা ছাড়াই পরিবার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া তাদের নৈতিক দায়িত্ব। অন্যদিকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নারীরা আরো বড় ভূমিকা এবং সমমর্যাদা প্রত্যাশা করে। প্রখ্যাত মুসলিম পারিবারিক কাউন্সিলর মোহাম্মদ রিডা বশির মুসলিমদের বলেন, শিশুসহ পরিবারের সব সদস্যের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

গবেষণায় আরো দেখা যায়, ব্যাপক সাংস্কৃতিক ব্যবধানের কারণে ভিন্ন জাতির মধ্যে বিয়ে টিকে না। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ভূমিকাও উদ্বেগের কারণ। স্বামী-স্ত্রী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক সময় আরো একটু স্বাধীনতা প্রত্যাশা করে এবং কারো অযাচিত হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করতে চায়। এই প্রত্যাশা পুরণ না হলে সংঘাত দেখা দেয়ার আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ধর্ম অনুশীলনের ভিন্নতাও স্বামী-স্ত্রীর মতানৈক্যের অন্যতম কারণ হতে পারে।

পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি সাতটির মধ্যে একটি বিবাহ বিচ্ছেদ হয় যখন স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে। দুর্ভাগ্যবশত ইসলাম দ্বিতীয় বিয়েকে উৎসাহিত না করলেও কিছু কমিউনিটি নারী ও শিশুদের ওপর এর বিরুপ প্রতিক্রিয়াকে উপেক্ষা করে পুরুষের দ্বিতীয় বিয়েকে সমর্থন দেয়।

গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়। এক্ষেত্রে কমিউনিটির প্রতিক্রিয়া সমান নয়। কোন কোন ইমাম নারীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে দ্রুত পুলিশকে নির্যাতনের বিষয়টি জানায় এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের চেষ্টা করে। বাকীরা অন্যায্যভাবে নারীদের ধৈয্য ধরার পরামর্শ দেয়। বিরক্তির বিষয় হচ্ছে, কোন কোন কমিউনিটি পুরুষ কর্তৃক সংঘটিত সহিংসতাকে মেনে নেয়।

বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ সম্পর্কে ভালভাবে বোঝার জন্য সাউন্ড ভিশন একটি অনলাইন জরিপ চালায়। ২০০৯ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে ১৫ জানুয়ারি ২০১০ সালের পর্যন্ত পরিচালিত ওই জরিপে অংশ নেয় নর্থ আমেরিকার ৪০৫ জন। তারা তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের অভিজ্ঞতাসহ এর কারণ এবং তারা কিভাবে এর মোকাবেলা করেছেন সে সম্পর্কে তাদের মতামত তুলে ধরেন। জরিপে অংশ নেয়া ৮৩.৩৩ শতাংশের বাস যুক্তরাষ্ট্র অথবা কানাডায়। অর্ধেকের বেশির জন্ম যুক্তরাষ্ট্র অথবা কানাডায়; বাকীদের কোন না কোন মুসলিম দেশে। ৬০ শতাংশের বেশি অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, তাদের এক্সস্পাউসের জন্ম বাইরের কোন দেশে। এক তৃতীয়াংশের কম এক্সস্পাউসের জন্ম যুক্তরাষ্ট্র অথবা কানাডায়। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি জনের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে ২-৫ বছরের মধ্যে, এক চতুর্থাংশের এক বছরের কম সময়ে এবং ১৭ শতাংশের ৬ থেকে ১০ বছরের মধ্যে।

দাম্পত্য জীবনের প্রথম পাঁচ বছর: সবচেয়ে কঠিন সময়

এক তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণকারীর বিয়ে টিকেছে দুই থেকে পাঁচ বছর; এক চতুর্থাংশের এক বছরের কম সময়। এদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশের বিয়ে টিকেছে ছয় থেকে দশ বছর, ১৬ শতাংশের ১১ থেকে ২০ বছর এবং ছয় শতাংশের একুশ থেকে ৪০ বছর। দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে বিয়ের প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে।

পুরুষেরা তুলনামূলক বেশি পুনঃবিবাহ করে

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার হার বেশি। পুরুষদের মধ্যে এই হার ৪৭.০৬ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ২৬.৪৮ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান থেকে একটা বিষয় আবারো প্রমাণিত হয়; আর তা হলো মুসলিম নারীরা পুনরায় বিয়ে করতে সমস্যায় পড়েন। কারণ ডিভোর্সি নারীদের ভাল চোখে দেখা হয় না।

নারীরা বেশি বিবাহ বিচ্ছেদের উদ্যোগ নিচ্ছে

অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ নারীরা জানিয়েছেন তারা নিজেরাই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন, যেখানে এক তৃতীয়াংশ জানিয়েছেন তাদের স্পাউস প্রথমে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করে।

জরিপে অংশ নেয়া ৬৪.৩২ শতাংশ মুসলিম নারী স্বীকার করেছেন তারা প্রথমে বিবাহ বিচ্ছেদের উদ্যোগ নেন। এই পরিসংখ্যান নর্থ আমেরিকান ও কানাডার মুসলিম কমিউনিটিতে নতুন একটি প্রবণতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। বর্তমানে অনেক বেশি সংখ্যক মুসলিম নারী বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদ সংক্রান্ত বিষয়ে নিজেরাই কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। মুসলিম সমাজের প্রচলিত ধ্যান ধারণার বাইরে এসে নর্থ আমেরিকান মুসলিম নারীরা এখন অনেক বেশি পরিমাণে নিজের সিদ্ধান্ত নিজের পছন্দ মতো নিচ্ছে এবং তারা পারিবারিক সহিংসতা আগের তুলনায় অনেক কম সহ্য করে।

বৈপরীত্য: বিবাহ বিচ্ছেদের একটি কারণ

বিয়ে ভাঙ্গার অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে সব সময়ই একটি কারণ থাকে প্রধান; যা বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে মূল ভূমিকা পালন করে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বৈপরীত্য বিবাহ বিচ্ছেদের সবচেয়ে বড় কারণ(১৬.৩৮%)। এরপরের অবস্থানে রয়েছে নির্যাতন (১৩.১২%), অর্থনৈতিক সংঘাত (১০.৪১%), পরিবার বা শ্বশুরবাড়ির কারো অনাহূত হস্তক্ষেপ (১০.২০%), দাম্পত্য জীবনে বিশ্বাস ভঙ্গ (৮.৭৯%) এবং অন্যান্য।

বৈপরীত্যগুলো বেশি হয় যখন স্বামী-স্ত্রীর একজনের জন্ম নর্থ আমেরিকায় অন্যজনের জন্ম মুসলিম বিশ্বে হয়। বিয়ের পর দাম্পত্য জীবনে সমস্যা দেখা দিলে বৈপরীত্যকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে অনেকে বিয়ে ভেঙ্গে দেয়।

মানসিক নির্যাতন: নির্যাতনের একটি সাধারণ ধরণ

যখন কেউ নির্যাতনকে বিয়ে ভাঙ্গার কারণ হিসেবে উল্লেখ করে তখন এক ধরণের নির্যাতনের কথা প্রায় সবাই বলে; আর তাহলো মানসিক নির্যাতন। জরিপে অংশ নেয়া প্রায় এক তৃতীয়াংশ (৩২.৩২%) মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা বলেছে, এক পঞ্চমাংশ (২১.৮০%) জানিয়েছে বকাঝকা করা কথা। আর ১৪.৭৯ শতাংশ অর্থনৈতিক নির্যাতন, শারীরিক নির্যাতন ১৩.৮৭ শতাংশ, ধর্মীয় নির্যাতন ৮.৯৯ শতাংশ এবং ৫.৭৯ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছে।

তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে নারীদের তুলনায় পুরুষেরা অধিক হারে মানসিক নির্যাতনের শিকার হন বলে পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। ৩৭.৭০ শতাংশ পুরুষ জানিয়েছেন তারা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। আর বকাঝকার কথা বলেছেন ২৪.৫৯ শতাংশ পুরুষ।

তবে বিবাহিত জীবনে পুরুষের তুলনায় নারীরা বেশি অর্থনেতিক, শারীরিক ও ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়।

মানসিক ও বকাঝকা করার মতো নির্যাতন প্রায়ই ঘটে। এই ধরণের নির্যাতন খুবই বিপজ্জনক কারণ এগুলো অন্যান্য নির্যাতনের মতো সব সময় চাক্ষুস দেখা যায় না। অনেকে সহ্যের সীমা অতিক্রমের আগ পর্যন্ত নিরবে এসব নির্যাতন সহ্য করে যায়।

অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনকারী তার নিজস্ব সংস্কৃতি কারণে বুঝতে পারে না যে তার কথা বা আচরণ অন্যজনের অনুভূতিকে আঘাত করছে এবং তা তাদের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

পরিবারের সমর্থন

বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়ায় বেশিরভাগ মানুষই তার পরিবারের সমর্থন পায় (৮২.১২%)। এক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় পরিবারের সমর্থন তুলনামূলক বেশি পায় (নারী ৮৪.৬৪% এবং পুরুষ ৬৭.৩৭%)। এ ঘটনা ইঙ্গিত দেয় যে মুসলিম কমিউনিটি তাদের প্রচলিত ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে আসছে। বেশিরভাগ মুসলিম পরিবারের বাবা-মা তাদের সন্তানদের বিবাহ বিচ্ছেদকে অপছন্দ এবং বাধা দেয়া হতো। বিশেষ করে স্ত্রীদেরকে পরিবারের সম্মান রক্ষা ও সন্তানদের মুখ চেয়ে সব সহ্য করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে উৎসাহ দেয়া খুবই সাধারণ ঘটনা।

বিবাহ বিচ্ছেদের আগে দু’জনের মাঝখানের দূরত্ব কমিয়ে আনতে অনেকেই পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের সাহায্য চায়। ২৮.২৭ শতাংশ তার পরিবার/আত্মীয় স্বজনের কাছে যায়, ২২.৪৪ শতাংশ যায় স্থানীয় ইমাম অথবা স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের কাছে, ২১.৫৩ শতাংশ তাদের বন্ধুদের সাহায্য চায়, মুসলিম কাউন্সিলরের কাছে ৮.৮২ শতাংশ, আইনজীবীর কাছে ৭.৫২ শতাংশ এবং অ-মুসলিম কাউন্সিলরের কাছে যায় ৭.৩৯ শতাংশ।

যেহেতু প্রায় অর্ধেক দম্পতি সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের পরিবার, স্থানীয় ইমামের কাছে যায়, সেহেতু এ থেকে এই বিষয়টা প্রতিয়মান হয় যে, পরিবারের সদস্য, কমিউনিটি লিডার সবাইকে বিয়ে সম্পর্কিত ইসলামিক আইন এবং সে যে দেশে বাস করছে সে দেশে বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদ সম্পর্কিত আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।

কমিউনিটির প্রতিক্রিয়া

বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটির প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে ২৪,৮৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জানায়, প্রতিক্রিয়া ছিল নেতিবাচক। ১২.৭৪ শতাংশ ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পায়, এবং ৩১.৮৫ শতাংশ জানায় কমিউনিটির প্রতিক্রিয়া ছিল নিরপেক্ষ। এছাড়া, ৩০.৫৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের কথা বাইরে প্রকাশ না করায় কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া ছিল না।

ঘটনা হচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেয় এক তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণকারী। এতে থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কমিউনিটিতে বিবাহ বিচ্ছেদকে কতটা লজ্জাজনক কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়।

এছাড়া, অংশগ্রহণকারীদের কাছে যখন জানতে চাওয়া হয়,“বিবাহ বিচ্ছেদের সময় তোমার যে সমর্থন বা সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটি কি তোমাকে তা দিয়েছে”? বেশিরভাগেরই উত্তর ছিল “না”( ৪৯.৩৪%)। হ্যা জবাব দিয়েছে ২৭.৬৩ শতাংশ এবং ২৩.০৩ শতাংশ জানিয়েছে তারা কিছুটা সহযোগিতা পেয়েছে।

বেশিরভাগ দম্পতি বিবাহ বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে ( ৪৮.০৮%) এবং ১৯.৫৫% কাজটা সম্পন্ন হয়েছে মসজিদ বা ইমামের মাধ্যমে। বাকীরা (৩২.৩৭%) বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে অন্যকোন উপায়ে, যেমন পেশাধারী মধ্যস্থতাকারী, বিচারক, শরিয়া কাউন্সিল, বন্ধু অথবা তিন বার তালাক বলার মাধ্যমে।

বর্তমান অবস্থা

যখন তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, “বিবাহ বিচ্ছেদের পর কি তোমরা কি আগের তুলনায় ভাল আছো”? ৯০.৬১ শতাংশের উত্তর ছিল “হ্যা”।

পরিশেষে বলা যায় পারিবারিক নির্যাতন রোধ এবং দাম্পত্য জীবনকে অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করে এমন আচরণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে কমিউনিটি লিডারদের শক্তিশালী ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।