কানাডায় প্রফেশনাল জব পেতে হলে নিজেদেরকে তৈরী করে নিতে হবে
প্রবাসী কন্ঠ রিপোর্ট
প্রণবেশ পোদ্দার : কানাডায় প্রতিবছর প্রচুর সংখ্যক অভিবাসী আসছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যারা শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে অনেক উঁচুমানের। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা কোনভাবেই অবহেলার যোগ্য নয়। এদের মধ্যে আছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও বিজ্ঞানীসহ আরো অনেক ধরণের পেশার অভিবাসী। তারা তাদের নিজ নিজ দেশের অনেক ভাল অবস্থান থেকে চলে এসেছেন কানাডায় আরো ভাল অবস্থানে পৌঁছাতে। সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা, উন্নত জীবনব্যবস্থা, উন্নত চিকিৎসা, ছেলে মেয়েদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই এদের অধিকাংশের চলে আসা কানাডায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, পেশাজীবী এই অভিবাসীদের সিংহভাগই স্ব স্ব ক্ষেত্রে চাকুরী পান না। তখন বাধ্য হয়েই ইঞ্জিনিয়ার চালান ক্যাব, ডাক্তার ডেলিভারী দেন পিজ্জা, বিজ্ঞানী কাটেন রেস্টুরেন্টে পিয়াঁজ। একজন ইঞ্জিনিয়ারকে ইঞ্জিনিয়ার হতে যে পরিমান সময়,শ্রম ও অর্থ ব্যয় করতে হয় বা ডাক্তার ও বিজ্ঞানীদেরকেও যে পরিমান সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করতে হয় তার ফিডব্যাক কি আসে ঐ ক্যাব চালিয়ে বা পিজ্জা ডেলিভারী দিয়ে? তারা যে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা এবং সর্বোপরি যে মেধা নিয়ে কানাডায় আসেন তার পরিনতিটা যে এরকম হবে তা কি কেউ ভেবেছিলেন দেশ ছাড়ার আগে?
বস্তুত : এরা না পারছেন কানাডার অর্থনীতিতে যোগ্যতমের অবদান রাখতে আর কানাডাও না পারছে এদেরকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে। তাদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও মেধার এই যে অপচয় বা অপমৃত্যু এর দায়ভার কে নিবেন? এ নিয়ে অভিবাসীরা কি ভাবছেন? প্রাবসী কন্ঠ ম্যাগাজিন আয়োজিত আজকের গোলটেবিল বৈঠকে আমরা এ নিয়েই আলোচনা করবো। আমি প্রথমেই আহ্বান করবো উদীচী কানাডার সভাপতি আজিজুল মালিককে তার বক্তব্য তুলে ধরার জন্য।
আজিজুল মালিক : কানাডায় অভিবাসীদের এ সমস্যাটি একটি খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এটি আজ নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে এই সমস্যাটি। আমরা জানি অভিবাসীদের মধ্যে অনেকেই কানাডা এবং বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোতে অনেক ভাল ভাল অবস্থানে কর্মরত আছেন। বাঙ্গালীদের কথাই যদি ধরি, এদের মধ্যে অনেকেই আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, বিজ্ঞানীসহ আরো অনেক পেশাজীবী। অর্থাৎ এই অভিবাসীরা যোগ্য বলেই যোগ্যতম স্থানে প্রবেশের সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু তারপরও দেখা যায়, অধিকাংশ অভিবাসী নানান প্রতিবন্ধকতার কারণে নিজ নিজ পেশায় চাকরী পান না বা তাদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি পান না। আমার কাছে মনে হয় এর মূল কারণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক।
আমরা দেখেছি, আদিকালে পশ্চিমারাই যেত ভারতবর্ষে তাদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য। কারণ, পৃথিবীর ঐ অঞ্চল তখন ছিল অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানেও উন্নত। আর আজকে আমরা আসছি পশ্চিমে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি বেশী হওয়ার কারণে। এ সুযোগটা নিচ্ছে পশ্চিমারা। পশ্চিমাদের দেশে পেশাজীবী হিসেবে কাজ করার জন্য যে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞাতা প্রয়োজন তা অভিবাসীদের আছে। অভিবাসীরা পশ্চিমাদের ভাষাও আয়ত্ব করেছে। কিন্তু তারপরও তারা অভিবাসীদেরকে প্রয়োজনীয় সুযোগ দিচ্ছে না মূলধারার পেশাভিত্তিক কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের। এটা মূলত ঐ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির কারনেই। আমরা অভিবাসীরা সে শক্তি এখনো অর্জন করতে পারিনি।
প্রণবেশ পোদ্দার : এবার বক্তব্য রাখার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি বিশিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ আলীকে।
মোহাম্মদ আলী : আমরা যখন কানাডায় আসি তখন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা আমাদের বলে দিয়েছিল যে এখানে আসার পর আমাদেরকে কিছু আপগ্রেড করতে হবে আমাদের একাডেমিক বিষয়ে এবং কিছু ট্রেনিংও নিতে হবে। কিন্তু কানাডায় আসার পর এখানে আর সে গাইডটুকু আমরা পাইনি। কোথায় যেতে হবে কার কাছে যেতে হবে কিছুই জানতাম না। ফলে আমরা সঠিক পথে এগুতে পারিনি। আমাদের অগ্রবর্তী যারা ছিলেন তারাও ভাল করে কিছু জানতেন না। আজকে আমাদের বিভিন্ন পেশাজীবীদের অনেক সংগঠন হয়েছে। তারা নানানভাবে উপদেশ দিতে পারেন।
কোথায় কোন ট্রেনিং নিতে হবে সবকিছুই তারা বলে দিতে পারেন। এতে করে প্রয়োজীয় ট্রেনিং নিয়ে অভিবাসীরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে চাকরীর চেষ্টা করতে পারেন। হয়তো সময় নিবে। তিন চার বছরও লেগে যেতে পারে।
আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। আজ থেকে পনের বছর আগে যখন আমি এসেছিলাম তখন আমি এই টরন্টোতে এসে উঠি। তখন আমার সার্টিফিকেটের স্বীকৃতি পেতে কোন অসুবিধা
হয়নি। কিন্তু টরন্টো ছেড়ে সাচকাচুন বা প্রেইরি রিজিয়ন যেখানে কৃষিকাজের প্রচুর সুযোগ রয়েছে সেখানে যাওয়ার ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেইনি। দেখি দেখি করে পনেরটি বছর পার করে দিয়েছি টরন্টোতে। আমাদের কৃষিবিদদেরকে কিন্তু তখন বলা হয়েছিল প্রেইরি রিজয়নে যাওয়ার জন্য। এমনো বলা হয়েছিল আমাদেরকে সমস্ত সুযোগসুবিধা দেয়া হবে। কিন্তু আমরা কৃষিবিদরা সে আহ্বানে তেমন সাড়া দেইনি। রয়ে গেছি টরন্টোতে যেখানে কৃষি কাজের কোন সুযোগ নেই। এখন আমরা কানাডা সরকারকে কতটা দোষারোপ করতে পারি তা একটু ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। নিজ ফিল্ডে চাকরী না পাওয়ার ক্ষেত্রে আমি একজন ভুক্তভোগী। কিন্তু নিজেকে যদি প্রশ্ন করি, আমি কতটুকু চেষ্টা করেছি কৃষি কাজে প্রবেশ করার জন্য তখন আমার কোন জবাব নেই।
আমরা আসলে যে কাজটি করতে পারি তা হলো যথাযথ ট্রেনিং নেওয়া। ব্যক্তিগতভাবে আমার অনেক এচভিমেন্ট আছে। আমি জাপান থেকে পিএইচডি করেছি। একাধিকবার এওয়ার্ডও পেয়েছি। কিন্তু এখানে টরন্টোর মিউনিসিপালিটির বাগানগুলোতে কাজ করার জন্য ইন্টারভিও দিয়ে টিকতে পারিনি। আমার যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে তা নয়। আসলে চাকুরীদাতারা যা চায় সেই নির্দিষ্ট কর্মদক্ষতাটুকু আমাদের নেই সঠিক অর্থে। ঐ নির্দিষ্ট কাজটি করার জন্য যে ট্রেনিং দরকার সেই ট্রেনিংটুকু আমাদের নেই। সুতরাং শুধু সরকারকে দোষারোপ না করে আমাদের নিজেদেরকেও একটু ভেবে দেখতে হবে। আমাদের যে বিষয়টির অভাব রয়েছে তা হলো সঠিক প্রশিক্ষন বা ট্রেনিং। সেই ট্রেনিং নিয়ে আমাদেরকে প্রমান করতে হবে কানাডায় আমরা রিসোর্স। লায়াবিলিটি নই।
প্রণবেশ পোদ্দার : এবার বক্তব্য রাখবেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব মোশারফ হোসেন।
মোশারফ হোসেন : আমি কানাডায় এসেছে মাত্র দু’বছর হলো। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এখানে বাস্তবতার নীরিখে বিষয়টি মোকাবেলা করা প্রয়োজন। আমরা দেখেছি এখানকার ক্রাইটেরিয়া অব ইমিগ্রেশনের মধ্যে যে কাঠামো তৈরী করা আছে সেই কাঠামোর সাথে বাস্তব জগতে যখন মানুষ কাজে যোগ দিবে সেখানে বাঁধা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। বাঁধাটা এমন যে ক্যারিয়ারের জন্য ট্রেনিং লাগবে এবং তারপর তারা কর্মস্থলে নিজেদের অবস্থান তৈরী করে নিবে। তাহলে এই মিথ্যাচারটা তারা কেন করলো। কানাডার ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইটে গেলে অমরা যা দেখি তার সাথে বাস্তবতার একটা বিরাটরকম ব্যবধান রয়েছে। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে যখন ইমিগ্রেন্টরা এদেশে আসেন তখন এখানকার কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হলো কোন কোন সেক্টরে কি কি কাজ আছে সেটা তাদের সম্মুখে উপস্থাপন করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ইমিগ্রেন্টদেরকে বিপথগামী করা হচ্ছে। যেমন একজন চিকিৎসাবিদকে বলা হচ্ছে আপনি ট্রের্নিং নিয়ে নার্সিং এর কাজ করুন। কৃষিবিদকে কৃষি কাজের বদলে বলা হচ্ছে অন্যকাজ করার জন্য।
আমরা যারা কানাডায় এসেছি আমরা চাই এখানকার মূলধারার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদেরকে সে সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। মূলধারার কাজে প্রবেশের ক্ষেত্রে নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে রাখা হয়েছে।
আমি মনে করি ইমিগ্রেন্টরা যেসব দেশ থেকে এসেছেন সেইসব দেশের দূতাবাসগুলোরও কিছু করনীয় আছে। নিজ নিজ পেশায় চাকরী পাওয়ার ক্ষেত্রে দূতাবাসগুলো ইমিগ্রেন্টদের হয়ে কানাডীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ইমিগ্রেন্ট ল অনুযায়ী দেনদরবার করতে পারেন। আমরা নিজেরাও দেনদরবার করতে পারি। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে সংগঠিত হতে হবে। সংগঠিত হয়ে এখানকার বড় বড় যে ফোরামগুলো আছে সেখানে আমাদের সমস্যাগুলো উপস্থাপন করতে হবে। তাদেরকে জানাতে হবে যে ইমিগ্রেন্টরা এদেশে এসে কি অবস্থায় আছেন। আমরা যে বঞ্চনার শিকার এটি জানানোর দায়িত্ব আমাদেরই। কানাডা একটি কল্যানকামী রাষ্ট্র। কিন্তু আজকে ইমিগ্রেন্টদের অবস্থা দেখে মনে এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, কোথায় কানাডার সেই কল্যানকামী ভূমিকা, কোথায় তার মানবাধিকার। বাইরের দেশে মানবাধিকার প্রশ্নে কানাডার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু দেশের ভিতরে কি হচ্ছে? কানাডায় যারা ইমিগ্রেন্ট হয়ে এসেছেন তাদেরকে মূলধারার কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের কোন সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। সুযোগ আমাদেরকে তৈরী করে নিতে হচ্ছে যা অত্যন্ত কঠিন কাজ।
প্রণবেশ পোদ্দার : আমরা ইতিমধ্যে একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তত্ব, একজন বিজ্ঞানী ও একজন সাংবাদিকের মূল্যবান বক্তব্য শুনলাম। এবার আমি আহ্বান জানাবো বাংলাদেশী কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মনির খানকে তার বক্তব্য তুলে ধারার জন্য।
মনির খান : কানাডায় আমরা যারা ইমিগ্রেন্ট তাদেরকে সামনের দিকে এগুতে হলে ঐক্যদ্ধ হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা যদি একই ছাতার তলে আসতে না পারি তবে আমরা কিছুই করতে পারবো না এ দেশে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কমিউনিটির কোন একটি বিষয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করতে গিয়ে আমরা সম্মিলিতভাবে না গিয়ে একাধিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আলাদা আলাদাভাবে গিয়ে হাজির হই। এতে করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষও বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। তারা তখন প্রশ্ন করে ‘‘তুমি কমিউনিটির প্রতিনিধি হলে তোমার পাশে ঐ লোকটি কে। সেও তো দাবী করছে সে কমিউনিটির প্রতিনিধি।” এরকম পরিস্থিতি বহুবার সৃষ্টি হয়েছে আমাদের কমিউনিটিতে। আর এ কারণে আমাদেরকে বিব্রত হতে হয়েছে কানাডিয়ানদের সম্মুখে। আমার কথা হলো, আমরা কমিউনিটির স্বার্থে কাজ করবো। কমিউনিটির লোকজন কিভাবে এখানকার সুযোগসুবিধা পেতে পারে, তারা কিভাবে মূলধারার জবমার্কেটে প্রবেশ করতে পারে এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করবো। কে সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হতে পারলেন, কে সেক্রেটারী হতে পারলেন না এগুলো নিয়ে যদি আমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়ে থাকি তবে আমরা সামনে এগুবো কি করে। আজকে দেখুন এখানে আমাদের কমিউনিটির নিজস্ব কোন কমিউনিটি সেন্টার নেই, নেই আরো অনেক কিছুই। অথচ যদি প্রতি ফ্যামিলি থেকে মাত্র দুই ডলার করে দেই প্রতি মাসে তবে কয়েক বছরের মাথায়ই আমরা নিজস্ব কমিউনিটি সেন্টারসহ আরো অনেক কিছুই করতে পারতাম। পরিপূর্ণ একটি কমিউনিটি সেন্টার থাকলে সেটার মাধ্যমে আমরা কানাডায় নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদেরকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ লোকের মাধ্যমে নানাভাবে পরামর্শ দিতে পারতাম। কোন জবের জন্য কোন ট্রেনিং পেলে তারা দ্রুত মূলধারার কর্মজগতে প্রবেশ করতে পারবেন এসব পরামর্শ দেয়া যেত। কিন্তু কমিউনিটি সেন্টার না থাকায় সে দায়িত্বটুকু আমরা পালন করতে পারছি না। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই নতুন আসা ইমিগ্রেন্টদেরকে ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দিতে গিয়ে নানা ভুল তথ্য দিয়ে থাকি। কারণ, আমরা অভিজ্ঞ নই। কাউকে পরামর্শ দেয়ার জন্য যে ট্রেনিং এর প্রয়োজন, সেটি ছাড়াই আমরা একেকজনকে একেক পরামর্শ দিয়ে বিভ্রান্ত এবং লাইনচ্যুত করে ফেলি। এতে করে নতুন আসা একজন ইমিগ্রেন্ট তার নিজের লাইন ছেড়ে অন্য দিকে চলে যায়।
প্রণবেশ পোদ্দার : এবার আমি আহ্বান জানাচ্ছি বাংলাদেশের আরেক বিশিষ্ট সাংবাদিক খসরু চৌধুরীকে।
খসরু চৌধুরী : আমরা যারা কানাডায় এসেছি ইমিগ্রেন্ট হয়ে তারা একটা বড়রকমের সময় কাটিয়ে এসেছি আমাদের পিছনে। ফলে আমরা কানাডায় এসেও কানাডিয়ান হয়ে উঠতে পারছি না। আমরা যারা এদেশে ব্যবসা করি বা করার চিন্তা করি তারাও সবসময় চিন্তা করি কমিউনিটির গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে ব্যবসা করবো। মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি বাঁধা। আমি দেখেছি এখানে অনেক সুযোগ রয়েছে। তবে এও সত্যি যে, প্রফেশনালদের জন্য অর্থাৎ যারা বিভিন্ন পেশায় বিশেষজ্ঞ বা দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সেই সব ইমিগ্রেন্টদের জন্য চাকরী পাওয়া কষ্টকর। দেশে থাকা অবস্থায় তারা দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন তাদের ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য। অনেকের হয়তো এই ক্যারিয়ার গড়ার পিছনে অনেক স্বপ্নও ছিল। এখন একটি নতুন দেশ ও নতুন পরিবেশে এসে এদের অধিকাংশকেই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না এতদিনের প্রিয় পেশাকে হঠাৎ করে পরিবর্তন করতে। তবে আমি মনে করি, অন্যান্য যারা আছেন, তারা বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সাময়িকভাবে হলেও পেশা পরিবর্তন করতে পারেন। এতে করে কানাডায় আসার পর তাৎক্ষনিক যে অর্থনৈতিক সমস্যাটা মোকাবেলা করতে হয় তার থেকে রেহাই পেতে পারেন নতুন ইমিগ্রেন্টরা। প্রয়োজনে সরকারী বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও গ্রহণ করা যেতে পারে এই ক্রান্তিকালের সময়টা। পরে অবস্থাটা যখন একটা স্থিতির মধ্যে আসবে তখন সুযোগবুঝে নিজ নিজ পেশায় প্রবেশ করার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। প্রথম অবস্থায় অর্থনৈতিক দুরাবস্থার মধ্যে থেকে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না।
প্রণবেশ পোদ্দার : এবার বক্তব্য রাখার আহ্বান জানাচ্ছি আরো একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক শওগাত আলী সাগরকে।
শওগাত আলী সাগর : কানাডায় আমরা যারা ইমিগ্রেন্ট হয়ে আসি তারা হুট করে কিছু একটা করে ফেলবো এরকম পরিস্থিতি আসলে এখানে নেই। এটা বাংলাদেশেও সম্ভব নয়। যারা মফস্বল থেকে রাজধানী ঢাকায় আসেন তারা সহসাই কোন ভাল প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করতে পারেন না। একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদেরকে অগ্রসর হতে হয়। এখন কানাডাকে যদি ঢাকা মনে করি এবং বাংলাদেশকে যদি সন্ধীপ না ধরে চট্রগ্রামও ধরি তবে এই কিছুটা পথ বা পক্রিয়ার মধ্য দিয়েইতো আমাদেরকে অগ্রসর হতে হবে। এখন এই পথটা পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যাটি কি?
বাংলাদেশে আমারা এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় রুটিরুজির বিষয়টি কোন না কোন ভাবে ম্যানেজ করে নিতে পারি। অত সমস্যা হয় না। কিন্তু কানাডায় সেই সুযোগটি নেই। এখানে পরিবার নিয়ে আসার পর প্রথমেই বাড়ি ভাড়া ও রুটিরুজির প্রবল ধাক্কাটা সামলাতে হয়। সে কারণে প্রফেশনাল জবের চিন্তা সেই মুহুর্তে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সারভাইভালের জন্য যে কোন জবে ঢুকে পড়তে হয়।
সমস্যা আরো আছে। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বলি। আমি যখন নয় বছর আগে কানাডায় আসি তখন আমি সঠিক কোন গাইডলাইন পাইনি। আমার যারা পরিচিত ছিলেন তাদের কাছে যে পরামর্শটি আমি পেয়েছিলাম তা হলো, হয় আমাকে ফ্যাক্টরী জবে যেতে হবে অথবা সেটি না পারলে রেস্টুরেন্টের জবে যেতে হবে। যেহেতু ফ্যাক্টরী জবে কায়িক পরিশ্রমটি বেশী এবং সেটি আমাকে দিয়ে হবে না সুতরাং রেস্টুরেন্ট জবই আমার জন্য উপযুক্ত। তারা আমাকে অযথা সময় নষ্ট না করে রেস্টুরেন্টের জব খুঁজতে বলেন। আমি মাঝে মাঝে পড়াশুনার কথা বলে তাদের কাছে পরামর্শ চেয়েছি। তাদের উত্তর ছিল, এটি একটি বিলাসিতা। লেখাপড়া যতই করুন, আপনার ফাইনাল ডেস্টিনি বা গন্তব্য হচ্ছে হয় ফ্যাক্টরী বা রেস্টুরেন্ট। সুতরাং আপনি সময়টা কেন নষ্ট করবেন।
এরকম কথা একাধিক লোকের কাছে শুনতে শুনতে একসময় আমিও সাইকোলজিক্যালি মনে করতে থাকি হয়তো তাদের কথাই সত্যি। এটাই বোধ হয় কানাডার জব মার্কেটের কালচার।
এখানে আরো একটি সমস্যা দেখা দেয়। যখন আমি বা আমার মতো কেউ প্রফেশনাল জব না পেয়ে বা ঐ প্রক্রিয়াকালীন সময়ে অন্য কোন সাধারণ জবে ঢুকে পড়ি, তখন জীবনটা একটা বাধাধরা নিয়মের মধ্যে আটকে যায়। অর্থাৎ জব, ফ্যামিলি আর গ্রোসারী এর মধ্যেই জীনটা অবর্তিত হতে থাকে। এর বাইরে বের হওয়ার আর কোন সুযোগ থাকে না তখন। আর আমরা যে সার্কেলের মধ্যে থাকি সেখান থেকে নতুন কোন তথ্যও আমরা পাই না। ফলে এটাকেই আমরা আমাদের নিয়তি বলে ধরে নেই।
তবে আশার কথা এই যে, এখন ঐ পরিস্থিতি আর নেই। সাম্প্রতিককালে যারা এসেছেন তারা যথাসময়েই অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য পেয়ে যাচ্ছেন। আর সেগুলো অথেনটিক তথ্য। ফলে বিভ্রান্ত হওয়ারও কোন সুযোগ নেই। কোথায় গেলে কি পাওয়া যাবে, কি কোর্স করলে কি জব পাওয়া যাবে ইত্যাদি সব তথ্যই নতুন আসা ইমিগ্রেন্টরা যথাসময়ে পেয়ে যাচ্ছেন। এতে করে তারা আটঘাট বেধে ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতে পারছেন এবং সেই অনুযায়ী অগ্রসর হতে পারছেন।
এখন আমরা দেশে যে যতবড় অবস্থানেই থাকিনা কেন, কানাডায় এসে যদি প্রশ্ন করি এখানে আমরা কি করতে পেরেছি? আমার মনে হয় না এটি কোন যৌক্তিক প্রশ্ন। কারণ, আমার মতে, আমরা যারা আগে এসেছি তারা সঠিক পথে এগুতে পারিনি।
প্রণবেশ পোদ্দার : এবার আমি আহ্বান জানাচ্ছি সর্বশেষ বক্তা বাংলাদেশের আরেক বিশিষ্ট সাংবাদিক জয়ন্ত বণিককে তার বক্তব্য রাখার জন্য।
জয়ন্ত বণিক: আমরা যারা কানাডায় আসি
তারা অনেকেই হতাশার কথা বলি। কিন্তু যারা হতাশাকে পাত্তা দেন না, যারা স্বপ্ন দেখেন,তারা একদিন না একদিন সাফল্যের মুখ দেখেন। আমাদের কমিউনিটিতেই এর অনেক উদারণ রয়েছে। কানাডা মেধা মৃত্যুর উপত্যকা একথা আমি মানতে রাজী নই। যারা হতাশায় ভোগেন, দেখা গেছে তারা কানাডায় এসে মিশেন ঐ হতাশায় ডোবা মানুষদের সঙ্গেই। ফলে একসময় তারাও হতাশ হয়ে পড়েন। আমি মনে করি চেষ্টা এবং পরিশ্রম থাকলে এদেশে অনেক কিছুই করা সম্ভব। তাই আমি বলবো, কানাডা মেধা মৃত্যুর উপত্যকা নয়, এটি হচ্ছে ল্যান্ড অব অপরচ্যুনিটির দেশ।
প্রণবেশ পোদ্দার : এতক্ষণ আমরা বিভিন্নজনের বক্তব্য শুনলাম। সবাই যার যার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকে তাদের মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন। আজকের এই আলোচনা থেকে যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হলো, কানাডা আসালে মেধা মৃত্যুর উপত্যকা নয়। এটি একটি সুযোগের দেশ। ভাগ্য গড়ার দেশ। হতে পারে নতুন ইমিগ্রেন্টদেরকে নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে এগুতে হয়। কেউ কেউ শুরুতেই হতাশ হয়ে পড়েন, আবার কেউ কেউ অনেক সংগ্রাম করে একপর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়েন। কারণ, প্রফেশনালদের জন্য অর্থাৎ যারা বিভিন্ন পেশায় বিশেষজ্ঞ বা দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সেই সব ইমিগ্রেন্টদের জন্য কানাডায় চাকরী পাওয়া কষ্টকর। অনেকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এখানকার মূলধারার কাজের সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত হতে পারছেন না বা তাদেরকে সে সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। তারা এটিকে দুর্ভাগ্যজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। মূলধারার কাজে প্রবেশের ক্ষেত্রে নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে রাখা হয়েছে বলেও তারা মনে করেন।
তবে আজকের আলোচনা থেকে যে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি আমরা পেলাম তা হলো, কানাডায় টিকে থাকতে হলে এবং সামনের দিকে এগয়ে যেতে হলে আমাদের নিজেদেরকে তৈরী করে নিতে হবে। আমরা যে যেই অবস্থান ও মেধা নিয়েই এদেশে আসি না কেন, আমাদেরকে এ দেশের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে নিতে হবে। এ জন্য আমাদের প্রয়োজন আমাদের শিক্ষাকে আপগ্রেড করা, প্রয়োজনে ভলন্টিয়ার হিসেবে কাজ করে হলেও কানাডিয়ান জব মার্কেটের অভিজ্ঞতা অর্জন করা।
পরিশেষে এরকম একটি সময়োপযোগী বিষয়ের উপর আলোচনা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহন করার জন্য প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনকে জানাই আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন। আর এত ব্যস্ততার মধ্যেও যারা আজকের আলোচনা অনুষ্ঠানে এসেছেন এবং মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন তাদের সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ।