কানাডায় অবশ্যই ভালো আছি : ডাক্তার আরিফ

মেধামৃত্যুর উপত্যকা হিসেবে কানাডাকে চিহ্নিত করে থাকেন অনেকেই। কারণ, মাস্টার্স আর পিএইচডি’র মতো উচ্চতর ডিগ্রি এবং বিস্তর অভিজ্ঞতা নিয়েও অনেকেই হারিয়ে যান এদেশে এসে। যে স্বপ্ন নিয়ে তারা এদেশে আসেন তার কোনটাই সফলতার মুখ দেখে না। ক্যাব চালানো আর পিজ্জা ডেলিভারী থেকে শুরু করে যাবতীয় অডবজই তাদের করতে হয় জীবন ও জীবিকার তাগিদে। এক পর্যায়ে হতাশা আর ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে তারা হয়ে উঠেন মানসিক রোগী।

তবে এর  উল্টো চিত্রও আছে কানাডায়। কঠোর পরিশ্রম আর সুযোগের সদ্ব্যবহার করে কেউ কেউ সাফল্যের শিখরে উঠে যান বৈরী এ আবহাওয়ার দেশে। পরিশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্যও তাদের সহায় হয়। ভাগ্যবান আর পরিশ্রমী এই ব্যক্তিরা কানাডাকে মেধামৃত্যুর উপত্যকা হিসেবে চিহ্নিত করতে নারাজ। তাদের মতে, কানাডা ইজ এ ল্যান্ড অব অপরচ্যুনিটি।

এই ভাগ্যবানদেরই একজন ডাক্তার আবু আরিফ। কানাডায় অন্যান্য পেশার চেয়ে ডাক্তারী পেশায় লাইসেন্স পাওয়া অনেক কঠিন। শত-সহস্র ইমিগ্রেন্ট ডাক্তারকে পেশা বদল করে জীবীকা নির্বাহ কররেত হচ্ছে লাইসেন্স নামের ঐ সোনার হরিনের সন্ধান না পেয়ে। এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশী এক চিকিৎসকের নিজ পেশায় কাজ করতে পারা নি:সন্দেহে আশাব্যঞ্জক এবং এটি নিঃসন্দেহে একটি সফলতার গল্প।

কানাডায় বর্তমানে ২ শ’র বেশি বাঙ্গালী ডাক্তার আছেন যাদের মধ্যে মাত্র ১৫ থেকে ২০ জনের আছে ডাক্তারী করার লাইসেন্স। এই ২০ জনের মধ্যে ৬ জনের অবস্থান টরোন্টোয়। ডাক্তার আরিফ সেই ভাগ্যবান ৬ জনের একজন। ২০০২ সালে স্ত্রীর পাঠানো স্পন্সরড্ ভিসা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় পাড়ি জমান তিনি।

সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করে দেশেই ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত হন ডাক্তার আবু আরিফ। সরকারি চাকরির পাশাপাশি প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতেন তিনি। স্বভাবতই তার কাছে প্রশ্ন ছিল এমন সফল একটি পেশায় থেকেও কেন কানাডায় অভিবাসী হলেন তিনি।

প্রবাসী কন্ঠ ম্যাগাজিনের সঙ্গে একান্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানালেন বাংলাদেশে কাজ করতে গিয়ে তার হতাশার কথা। তিনি বলেন, “কানাডায় আসার অনেক কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি…সব জায়গায় দুর্নীতি।…তারপর দেখলাম কোথাও চেইন অব কমান্ড নেই, আপনি একটি হাসপাতালে কাজ করেন, দেখবেন অধিনস্তরা আপনার কথা শুনছে না”। বলছিলেন আবু আরিফ।

এতো গেলো দেশের কথা। কানাডায় অভিবাসনের পর শুরুটা মোটেই সহজ ছিল আরিফের জন্য। কানাডায় এসে তিনি অনেক ডাক্তারকে দেখেছেন অন্য পেশায় কাজ করতে। এমনকি অনেকে ডাক্তারি ভুলেও গেছে। একটা সময় তিনি মনে করেন তার পক্ষেও হয়তো আর ডাক্তারি পেশায় যাওয়া সম্ভব নয়। আরিফের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল কিভাবে তিনি তার স্বপ্নকে বাস্তব করলেন। এক্ষেত্রে আরিফের হাটা পথ হতে পারে অন্যান্যদের জন্য অনুসরনীয়। তিনি জানান, কানাডায় আসার আগে কানাডার চাকরির বাজার নিয়ে রীতিমত নানারকম প্রস্তুতি নেন

 তিনি। কানাডায় আসার পর প্রতিদিন কমপক্ষে ১৮ ঘন্টা পড়াশোনা করেছেন তিনি। এসময় তাকে মানসিক ও আর্থিক সহায়তা করেছেন তার স্ত্রী, সেকথাও জানাতে ভুলেননি আরিফ। তার আজকের এই সাফল্যের পিছনে তার স্ত্রীর যথেষ্ট অবদান রয়েছে বলে তিনি জনান। স্ত্রীর সাহায্য সহযোগিতা না পেলে কানাডায় তিনি ডাক্তার হয়ে উঠতে পারতেন না।

ডাক্তার আবু আরিফ বলেন, স্ত্রীর সহযোগিতার  পাশাপাশি কানাডায়  টানা তিন বছর কঠোর অধ্যবসায় ও ঐকান্তিক চেষ্টার পর অনেকগুলো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই টরোন্টোতে ডাক্তারি করার লাইসেন্স পান তিনি। পাশাপাশি ভাগ্যও তার সহায় ছিল বলে মনে করেন এই ডাক্তার।

কথা প্রসঙ্গেই জানা গেল অনেক যোগ্যতা থাকা সত্বেও বাংলাদেশ বা অন্যদেশ থেকে কানাডায় আসা অভিবাসীরা কেন নিজ পেশায় স্থায়ী হতে পারেন না। কানাডায় আসার পর অনেকের প্রস্তুতি থাকে না, নিজের সংসার গোছাতে ব্যস্ত থাকায় নিয়মিত পড়াশোনা করা হয়ে ওঠে না; দেশ থেকে নিয়ে আসা সীমিত পুঁজি নিয়ে বেঁচে থাকাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। ফলে বেঁচে থাকার তাগিদে হাতের কাছে যে চাকরিই পাওয়া যায় তাই করতে বাধ্য হয় অভিবাসীরা।

ডক্তার আরিফ জানান মেডিকেল পেশার ডিগ্রী ও অভিজ্ঞতা থাকলেও তা যদি কানাডার বাইরের হয় তবে তা মেনে নেয়া হয় না এখানে। ফলে বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয় সব অভিবাসীকে। এতটুকু পড়ে যারা ভাবছেন, লাইসেন্স পেয়ে গেলে তো সমস্যা শেষ, তাদের জন্য বলি, বর্ণবাদ বা বৈষম্য লাইসেন্স পাওয়ার পরও শেষ হয়না কানাডায়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই সফল চিকিৎসক আরিফ জানান, বাংলাদেশী কমিউনিটিতে তিনি বেশ জনপ্রিয় হলও শ্বেতাঙ্গদের কেউ কেউ তার কাছে আসতে চান না। অনেকের চোখে মুখে থাকে তাচ্ছিল্যের ছাপ। তবে ইতিবাচক দিক হলো, বৈষম্যকারী এসব লোকের সংখ্যা নেহায়েত নগন্য। আর খুব ধীরে হলেও পরিবর্তন ঘটছে তাদের মধ্যেও।

কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হন বলেও জানান আরিফ। প্রবাসী বাংলাদেশী রোগীরা চিকিৎসকের বাতলে দেয়া টেস্ট করান না। এরপর অনেক সময় এমনো হয় এক বছর পর ক্যান্সার নিয়ে খুব খারাপ অবস্থায় আবার তার কাছে আসেন তারা। তখন আর কিছুই করার থাকে না। পশ্চিমা সংস্কৃতির নেতিবাচক দিক উল্লেখ করে ডাক্তার আরিফ বলেন, অনেক তরুণ ড্রাগ নেয়ার জন্য জোর করে, তাদের ইচ্ছেপূরণ না হলে দুর্ব্যবহার করে। এসব মেনে নিয়েই ডাক্তারি পেশা চালিয়ে নিতে হয়।

কথপোকথনে উঠে আসে দেশী-বিদেশী চিকিৎসার পার্থক্য। আরিফের মতে, বাংলাদেশে রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে একজন চিকিৎসকের মতামতই যথেষ্ট কিন্তু কানাডায় ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। কানাডায় চিকিৎসারত রোগীকে জানানো হয় তার সমস্যা ও সমাধানের সম্ভাব্য পথগুলো। এরপর রোগীই সিদ্ধান্ত দেন তিনি কি করতে চান। সুস্থ হওয়ার পর রোগী যেন বাসায় একা চলাফেরা করতে পারে তাও নিশ্চত করা হয়, এজন্য সমাজকর্মীদের সাহায্য নেন ডাক্তাররা।

নিজের সন্তানদের ভবিষ্যতে কিভাবে দেখতে চান জানতে চাইলে তিন ছেলের জনক আরিফ বলেন, “…আমি যেখানে শেষ করবো, সেখান থেকেই তারা শুরু করবে”।

সবকিছু মিলে তার কাছে প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশের তুলনায় কানাডায় ভালো আছেন কিনা। জবাবে সফল এই বাংলাদেশী চিকিৎসক জানান, পেশাগত দিক চিন্তা করলে অবশ্যই ভালো আছি।

দেশে ফেলে যাওয়া আত্মীয় স¡জনের জন্য মন কাঁদে জানিয়ে আরিফ বলেন, তার সফলতার জন্য টরোন্টোর বাংলাদেশী কমিউনিটির কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা তিনি পেয়েছেন বলেও জানান আবু আরিফ। কানাডার উন্নত জীবনে অনেক কিছু পেলেও কোরবানি ঈদে গরু কিনতে হাঁটে যাওয়া বা রোজার ঈদে সেমাই খাওয়া, সবাই মিলে ঈদের কাপড় কেনারা সুখ স্মৃতি এখনো হাতড়ে বেড়ান সফল এ চিকিৎসক।