অভিবাসীদের ভবিষ্যত প্রজন্মই ভবিষ্যত কানাডা গড়ার নতুন কারিগর

এমিলি রোজ : আপনি কেন কানাডায় এসেছেন?- এ প্রশ্নটির উত্তরে যা বেশি শুনতে পাওয়া যায় তা হলো: “আমরা এখানে এসেছি আমাদের সন্তানের জন্য”।

পরিবার নিয়ে আসুক আর পরিবারের জন্য আসুক, শিক্ষা ও পেশাগত দিক বিবেচনা করে সন্তানকে সর্বত্তোম সুযোগ দিতেই কানাডায় আসে তারা যা নিজ দেশে পায় না।

স্বভাবতই অভিবাসীদের নিয়েই একটি প্রজন্ম গড়ে ওঠা অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়; পরিসংখ্যান বলছে কানাডার ২০ শতাংশ মানুষ বিদেশী বংশোদ্ভূত যার এক তৃতীয়াংশই তরুণ। উপরন্তু ১৭ শতাংশ দ্বিতীয় প্রজন্মের কানাডীয় অর্থাৎ যাদের বাবা-মায়ের একজন কানাডার বাইরে জন্মগ্রহণ করা।

সাধারণত, এসব তরুণদের ভবিষ্যৎ বেশ উজ্জ্বল মনে হয়। আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য, সাংস্কৃতিক দূরত্ব সত্বেও বিগত কয়েক দশকে উল্ল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে এসব তরুণ। টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে এ চিত্র।

শিক্ষাগত দিক থেকে তারা স্থানীয়দের পেছনে ফেলছে। ব্যবস্থাপনা বিষয়ক চাকরিগুলোতেও ভালো করছে তারা, বিশেষত চীন ও দক্ষিণ এশিয় বংশোদ্ভূতরা।

গবেষণাটির নেতৃত্ব দেয়া টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের জেফরি জি রিটজ বলেন, “কানাডীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে এসব তথ্য আশাব্যঞ্জক”। “ মূলধারার কানাডীয়দের মধ্যে ২৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের আয় ৫০ হাজার ডলার আর চীনা বংশোদ্ভূতদের আয় ৬৩ হাজার ডলার।

কেন এমনটা হয়? রিটজের মতে, এর উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে অভিবাসীদের বাবা-মায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে তাকালে।

“আর্থিক দুরাবস্থা থাকলেও শিক্ষার গুরুত্ব  তাদের সন্তানকে বোঝাতে ভুল করে না তারা, যার বিনিময়ে ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ পায় তাদের সন্তানরা”।

সাফল্যের পথ

কানাডার অভিবাসীদের সাফল্যের পথে হাঁটা একজন ১৭ বছর বয়সী এস. সিনহা। তেল ও গ্যাসক্ষেত্রে চাকরির জন্য ক্যালগারিতে ৫ বছর আগে অভিবাসিত হয়ে আসে সিনহা পরিবার।

ভারতের উত্তরাঞ্চল এলাহাবাদ থেকে আসা পরিবারটি আবিস্কার করলো কানাডার জীবন ভারতের থেকে আলাদা।

তবে ভিন্ন এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে তারা  দমে যায়নি । হাই স্কুলেই আইভি লীগের সামার স্কুলে যেত সে, কাজ করতো  ইউনিভার্সিটি অব ক্যালগারি ল্যাবে, তার কাজের বিষয় ছিল স্টেম সেল নিয়ে গবেষণা, নিউরোবায়োলজি। সে বলে, “মানবদেহের অনন্য ও আকর্ষণীয় টিস্যু হচ্ছে মস্তিস্ক”। “আমাদের মস্তিস্ক কিভাবে কাজ করে তা এখনও পুরোপুরি জানি না আমরা”। স্টেমসেল নিয়ে সিনহার গবেষণা জাতীয় ও  আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দৃষ্টি কেড়েছে, যা তাকে নিউরো সায়েন্টিস্ট ও নিউরোসার্জন হতে প্রেরণা যোগাচ্ছে।

সম্প্রতি কানাডার বিখ্যাত ম্যাকলিন ম্যাগাজিন তাকে “২৫ বছরের কম বয়সী উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি” হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইয়ুথ ইন মোশান তাকে কানাডার ২০ বছর বয়সী সেরা ২০ জনের তালিকায় নিয়ে আসে। রয়েল ব্যাংক অব কানাডার কানাডিয়ান ইমিগ্র্যান্ট অ্যাওয়ার্ডের  (২০১৩)  প্রথম ২৫ জনের একজন নির্বাচিত হন সিনহা। সিনহার মত এমন তরুণ অভিবাসী সাফল্যের জন্য প্রেরণা পায় কোথা থেকে?

তরুণদের সাফল্য গাঁথা

বাবা-মা, তরুণ ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা ৩১ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সমাজ কর্মী গ্যারি ডায়ার্নফিল্ড জানান অন্যসব তরুণকে সফল করতে যে বিষয়গুলো কাজ করে অভিবাসী তরুণদের জন্যও তা ঠিক একই রকম। তিনি বিশ্বাস করেন ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য অনুপ্রেরণাই মানুষকে তার সাফল্যের মাপকাঠিতে বসায়। “কিছু মানুষ আছে যারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ভালোবাসে-তারা যা করতে চায় তার পিছেই ছোটে, তারা ভালো কিছু করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ”।

সিনহা জানে তার অনুপ্রেরণার প্রয়োজনীয়তা কোথায় এবং তা সাফল্যের জন্য ব্যবহার করতে। সিনহা বলেন, “ যখন আপনি এমন কিছু পাবেন যা করতে আপনার ভালো লাগে, তখন আপনার তার পেছনে লেগে থাকা উচিত, কারণ মানুষের সহজাত প্রবণতা হলো অলস সময় কাটানো। কোন কিছু করার প্রত্যয় সেই পরিস্থিতিকে কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে”।

তিনি আরো বলেন, “আমাকে যা অনুপ্রেরণা যোগায় তা হলো মানুষের জ্ঞানের পরিসীমায় পৌঁছে তা থেকে নতুন কিছুর দিকে এগুবার প্রবণতা”।

তরুণদের সফলতার জন্য ব্যক্তিগত অনুপ্রেরণার পাশাপাশি পরিবারের সহযোগিতাও খুব জরুরী। ডায়ার্নফিল্ড ব্যাখ্যা করেন, “তারা একাই যে সবটা করছে তা নয়, তাদের আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, কমিউনটিও তাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আর তারাই তরুণদের এ যাত্রায় সহযাত্রী হতে পারে”। রিটজের মতে, অভিবাসি বাবা-মা’রা উদাহরণ ও দিক নির্দেশনার মাধ্যমে তরুণদের উৎসাহিত করে। অভিবাসনের পর ওইসব মা-বাবা নিজেরা চাকরির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করায় সন্তানদের সফলতা তাদের কাছে বড় হয়ে ওঠে।

এছাড়া রয়েছ “অভিবাসীদের কর্মক্ষেত্রের নীতি”। এক্ষেত্রে সফলতার জন্য তারা তাদের সন্তানদের কাছে কঠোর পরিশ্রমের দৃষ্টান্ত তৈরি করে।

কসি স্টবস একজন দ্বিতীয় প্রজন্মের কানাডীয়, যার পরিবার উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে মাত্র ১ শ’ ডলার নিয়েই জ্যামাইকা ছেড়ে পাড়ি জমায় কানাডায়। তারা তাদের সন্তান স্টবসের মধ্যে কাজের অদম্য স্পৃহাকে গেঁথে দেয়। ফলে অল্প বয়সেই কঠোর পরিশ্রমের মূল্য বুঝতে পারেন স্টবস। “ বোধ হওয়ার পর থেকে দেখছি এমন কোন দিন নেই যে আমার বা-মা কাজে যাননি। যত অসুস্থ্যই থাক না কেন তারা কাজে যেতেন। কাজের প্রতি এই ভালোবাসা আমার মনে গেঁথে আছে”।

১৫ বছর বয়সে একটি বার্গার চেইন শপে রাধুনির কাজ করতেন স্টবস। সেইসময় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ৩০ বছর বয়সের মধ্যেই ১০ টি সম্পত্তির মালিক হবেন তিনি। এখন তার বয়স ৩১ আর তিনি মাল্টি মিলিয়ন ডলারের একটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসার প্রতিষ্ঠাতা। “ কর্মস্পৃহা ছাড়া কোন কিছু সম্পন্ন করা অসম্ভব” ,বলছিলেন অন্য তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দেয়া স্টবস। তার চলমান এ সাফল্যে উল্ল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে স্টবসের পরিবার। বিশেষত ২০০৬ সালে মৃত্যুবরণ করা তার ভাইয়ের স্মৃতি। “আমার লক্ষ্য ছিল তার সম্মানে বড় কিছু করা। আমার মনে হয় সে সবসময় আমাকে দেখছে যা আমাকে সদা ব্যস্ত রাখে কাজে”।

একত্রীকরণের প্রশ্ন

 নতুন আসা দেশটির মূল স্রোতে কতটুকু মিশতে পারছে অভিবাসীরা- তার প্রভাবও রয়েছে তরুণদের সাফল্যে। নিজের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে লালন করার পাশাপাশি কানাডীয় সংস্কৃতিকে কি মেনে নিতে পারছে তারা? ডায়ার্নফিল্ডের মতে, যেসব বাবা-মা কানাডার সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিয়েছেন তাদের সন্তানরা বেশি সফল। “ এর মানে এই নয় পুরোনো সংস্কৃতিকে ভুলে যাচ্ছেন তারা বরং একই সঙ্গে দু’টি জগতে সাচ্ছন্দ্যের সাথেই বাস করছেন তারা। তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন এমনটি মনে করেন না ”। গবেষণায় দেখা গেছে সম্ভবত স্কুলের কারণেই বয়স্ক অভিবাসীর চেয়ে দ্রুত কানাডীয় সংস্কৃতিতে মানিয়ে যায় তরুণ অভিবাসীরা। একত্রীকরণের জন্য বেশ কিছু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে ভাষা ও সামাজিক একত্রীকরণ কর্মসূচি রয়েছে। ডার্নফিল্ড বলেন, “ এসব কর্মসূচি নতুন জীবনে তাদের অর্ন্তভুক্ত করাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে”। “যেসব স্কুলে এরকম প্রোগ্রাম থাকে না সেসব স্কুলের শিক্ষার্থীদের কানাডীয় জীবনধারা থেকে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি”।

সিনহার উক্তি এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। “যখন আপনি কোন বিষয় খুব অল্প বয়স থেকেই জানবেন সেটি আপনাকে স্বতন্ত্র করে তুলবে, আমি যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতাম তাতে আমাকে খাপ খাইয়ে নেয়ার একটি বিষয় ছিল।

তার পরও তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন জরুরী। রিটজ বলেন, যেহেতু অভিবাসীরা মূলধারার সমাজের চেয়ে নিজের কমিউনিটিতে বেশি জড়িত নিজ কমিউনিটির সংস্কৃতির দ্বার্ইা বেশি প্রভাবিত তারা”। আর এসব কমিউনিটি শিক্ষা ও পেশা- ঐতিহ্যবাহী এই বিষয়গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

বিষয়টি সিনহার ক্ষেত্রে বেশ স্পষ্ট। তিনি বলেন, “ আমি বলতে চাই আমি কোথায় শেষ করবো, আমি মেডিসিন প্র্যাকটিস করতে চাই এবং মানুষকে ওষুধের ক্লিনিকাল দিক থেকে প্রভাবিত করতে চাই। কিন্তু টুয়েলভ গ্রেডের পর কি করবো তা সময়ের ওপর ছেড়ে দিলাম”। দেখা যাক সিনহা কি করেন।   – সৌজন্যে : কানাডিয়ানইমিগ্রেন্ট.সিএ